‘বাবাকে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে যুদ্ধে যাই’

ময়মনসিংহ, জাতীয়

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 04:48:20

‘মুক্তিযুদ্ধের বছর ১৯৭১ সালে আমি গৌরীপুর কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। তখন আমি ডিগ্রি ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। একদিন শনিবার বাবাকে বললাম পাশের গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছি। এরপর কাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে ঘরে থাকা দশ টাকা নিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে পায়ে হেঁটে বিজয়পুর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারত যাই। ভারতের মেঘালয় প্রদেশে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকায় যুদ্ধ করি। এরপর ৫ নভেম্বর গৌরীপুর ফিরে আসি। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গৌরীপুর হানাদার মুক্ত করি।’

১৯৭১ সালে দেশ রক্ষার যুদ্ধে যাওয়ার গল্পটা এভাবেই বার্তা২৪.কমের কাছে তুলে ধরেন সেদিনের বিশ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ।

আবুল কালামের বাড়ি উপজেলার বেকারকান্দা গ্রামে। তার বাবা মৃত জোবেদ আলী সরকার। মা মৃত আমেনা বেগম। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বর্তমানে তিনি ময়মনসিংহ জেলা শহরের জজ কোর্টে আইন পেশায় আছেন। দাম্পত্য জীবনে তার এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে।

শনিবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে পৌরশহরে হাতেম আলী রোডস্থ আবুল কালামের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে বসে কথা হয় এ প্রতিনিধির। কথা প্রসঙ্গে যুদ্ধদিনের নানা ঘটনা তুলে ধরেন তিনি। আবুল কালাম বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। এই ভাষণ শোনার পর আওয়ামী লীগ নেতা হাতেম আলী মিয়া এমসিএর নেতৃত্বে আমরা ২০-২৫ জনের একটি দল সংঘবদ্ধ হই। ২৬ মার্চ যুদ্ধ শুরু হয়। ১৬ এপ্রিল হাতেম আলী ভাইয়ের নির্দেশে আমরা কয়েকজন সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাটের কুদরত আলী মণ্ডল এমসিএর কাছে যাই অস্ত্র আনার জন্য। কিন্তু কুদরত ভাই অস্ত্র না দিয়ে ভারত চলে যান। তাই খালি হাতে ফিরতে হয় গৌরীপুর।

এদিকে গৌরীপুর ফিরে জানতে পারি হাতেম আলী তার লোকজন নিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে ভারত চলে গেছেন। মন খারাপ হয় আমার। কিন্তু আমি দমে যাওয়ার পাত্র নই। ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল আমি বাবাকে জানাই পাশের গ্রামে বেড়াতে যাচ্ছি। এরপর কাপড়ের ব্যাগ ও দশ টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে ভারতের পথে রওনা হই। আমার সঙ্গে আরও ছিলেন স্থানীয় কনু মিয়া, নূরুল আমিন ও একটি হিন্দু ছেলে। পথিমধ্যে দূর্গাপুর থানার কাকুড়াকান্দা গ্রামে পৌঁছালে একদল সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী আমাদের গতিরোধ ও মারধর করে বেঁধে রেখে মালামাল লুট করে।

এর একদিন পর দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দূর্গাপুরের বিজয়পুর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের বাঘমারা বিএসএফ ক্যাম্পে যাই। সেখানে গিয়ে দেখা হয় গৌরীপুরের হাতেম আলী ভাই, ফজলুল হক, ডা. এম এ সোবহান, নজমুল হুদা এমসিএ, তোফাজ্জল হোসেন চুন্নু, হাসিম ভাইসহ পরিচিত অনেকের সঙ্গে। সেখান থেকে মেঘালয় ক্যাম্পে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেই। ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় দক্ষতা থাকায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আমি দোভাষীর দায়িত্ব পালন করতাম।

যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে আমিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল মেঘালয় সীমান্তের জক্স গ্রামে আস্তানা করি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ওই দলটির কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন চুন্নু। ভারত থেকে বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে প্রায়ই পাকিস্তানি ক্যাম্পে হামলা করে আস্তানায় ফিরে আসতাম।

১৯৭১ সালের ২৫ জুন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মুরারি আমাদের নিয়ে বিজয়পুর পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করে। ২৬ জুন ভোর ৬টায় বিজয়পুর বাঘমারা এলাকার মধ্যবর্তী পাহাড়ে আমরা ৭২ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল ভারী অস্ত্র, গোলাবারুদসহ সশস্ত্র অবস্থান নেই। সাড়ে ৬টায় দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। অর্ধশতাধিক পাকসেনা মারা যায়। একটি গাছের আড়াল থেকে আমি ও সহযোদ্ধা সন্তোষ পাকবাহিনীদের লক্ষ্য করে গুলি করছিলাম। এ সময় পাকবাহিনীর একটি মর্টার শেল সন্তোষের মাথায় আঘাত করলে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় সে। ওই যুদ্ধে অর্ধশতাধিক পাকসেনা আমাদের হাতে মারা যায়। আমরা জয়ী হয়ে বিজয়পুর ক্যাম্পে লাল সবুজ পতাকা ওড়াই। তবে প্রতিকূল পরিবেশের কারণে সেদিন সন্তোষের মৃতদেহ ধর্মীয় রীতিনীতি ছাড়াই পুড়িয়ে ফেলতে হয়েছিল।’

কথা প্রসঙ্গে আবুল কালাম বলেন, ‘বিজয়পুর ক্যাম্প দখলের কিছুদিন পর দূর্গাপুর থানার কলসিন্দুর গ্রামে আমার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকবাহিনীর ওপর হামলা চালায়। ওই যুদ্ধে নয়জন পাকসেনা মারা যায়। আগস্ট মাসে আমরা তোফাজ্জল হোসেন চুন্নুর নেতৃত্বে দূর্গাপুরের ঘোঁষগাও গ্রামে পাকিস্তানি ক্যাম্পে হামলা চালাই। দেড়ঘণ্টার যুদ্ধে আমাদের দুজন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারায়।’

জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৫ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নিয়ে গৌরীপুর আসেন আবুল কালাম। পাকিস্তানি দোসর ও রাজাকাররা তখন গৌরীপুর থানায় অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধাদের গতিবিধি পাকবাহিনীকে অবহিত করত।

আবুল কালাম বলেন, ‘১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় কোম্পানি কমান্ডার রফিকুল ইসলাম ও আমাদের দল যৌথ অভিযান পরিচালনা করে গৌরীপুর থানা দখল করি এবং লাল সবুজ পতাকা ওড়াই। তখন পাকিস্তানি দোসর ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করে। অনেকে পালিয়েও যায়। হানাদার মুক্ত হয় গৌরীপুর।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ ঘটনার পর পাকবাহিনী যেন এলাকায় না ঢুকতে পারে সেজন্য ৮ ডিসেম্বর রাতে গৌরীপুর-ময়মনসিংহ রেলপথের একটি ব্রিজ ও ৯ ডিসেম্বর গৌরীপুর-ময়মনসিংহ সড়কপথের গুজিখা ব্রিজ বোমা মেরে ধ্বংস করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেই। ১০ ডিসেম্বর ব্রহ্মপুত্র নদী পাড় হয়ে জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ময়মনসিংহ হানাদার মুক্ত করি।’

আবুল কালাম মুহাম্মদ আজাদ ১৯৭২ সালে ডিগ্রি, ১৯৭৬ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি এলএলবি কোর্স সম্পন্ন করে আইন পেশায় যুক্ত হন। একই বছর তিনি গৌরীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। আইন পেশার পাশাপাশি তিনি বর্তমানে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গৌরীপুর শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর