ঢাকা: 'প্রাচ্যের রোমান্টিক সিটি'র করুণদশা!

, জাতীয়

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 17:01:05

দূষিত শহরের তালিকায় সারা বিশ্বের মধ্যে সবার শীর্ষে স্থান পেয়েছে একদা মুঘল ও ব্রিটিশদের 'গার্ডেন সিটি' ঢাকা। রমনীয় রমনার সুরম্য বাগ-বাগিচার কারণে যে শহরের নাম ছিল 'প্রাচ্যের রোমান্টিক সিটি', তা এখন এক অলিখিত মৃত্যুকূপ। ১৬ জুলাই ১৬০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও পরিকল্পিত রাজধানী শহরের এহেন করুণদশা শুধু অকল্পনীয়ই নয়, বেদনাবহও বটে।

বিশ্ববিশ্রুত পর্যটক, লেখক, শিল্পীর লেখা ও রেখায় বুড়িগঙ্গা তীরের হর্ম্য, প্রাসাদ, বাগিচা ও নান্দনিকতার যে ঢাকা শহরের বিবরণ পুলকিত করে আমাদের, সেই ঢাকা বহু আগেই স্মৃতির অতল গর্ভে হারিয়েছে। ঢাকার বুকের মাঝখানে হৃৎপিণ্ডের মতো যে সবুজ-শ্যামলিম রমনা ছিল, বৃক্ষতলের ধানমণ্ডি, পুরানা পল্টন, গেন্ডারিয়া ছিল সেসব খুলবে খেয়েছে লোলুপ মানুষেরা। ঢাকার ল্যান্ডস্কেপে নিসর্গ ও সবুজ বলতে কিছুই যেন অবশিষ্ট নেই। শতবর্ষী বহু প্রাচীন বৃক্ষ কর্তিত হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়নের থাবায়। ফলস্বরূপ, ঢাকার স্কাইলাইনে খাঁখাঁ ধূসরতা আর দূষিত বায়ুর আচ্ছাদন, যা একদার সুরম্য নগরীকে পরিণত করেছে বিশ্বের এক নম্বর দূষিত, অস্বাস্থ্যকর নগরে।

কিছুদিন ধরেই এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) স্কোর ২২১ নিয়ে ঢাকার বাতাসের মান ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ অবস্থায় রয়েছে। এ তালিকায় আমাদের পরেই রয়েছে ভারতের দিল্লি ও ঘানার আক্রা। তারপর পাকিস্তানের লাহোর, চীনের উহান প্রভৃতি শহর।

বিশেষজ্ঞরা ১০১ থেকে ২০০ এর মধ্যে একিউআই স্কোরকে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে মনে করেন। ২০১ থেকে ৩০০ এর মধ্যে থাকা একিউআই স্কোরকে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ বলা হয়। আর ৩০১ থেকে ৪০০ এর মধ্যে থাকা একিউআইকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে বিবেচনা করা হয়, যা বাসিন্দাদের জন্য গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। ঢাকায় সেই স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে হাতেনাতে। বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদফতরের মতে, বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন।

বস্তুত, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান 'আইকিউ এয়ার' এ তালিকা প্রকাশ করে ফি বছর। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতোটুকু নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের জন্য কোনও ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে, তা জানায়।

বাংলাদেশের সামগ্রিক একিউআই পাঁচটি দূষণকারী মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে কণা পদার্থ (পিএম ১০ এবং পিএম ২.৫), কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও ওজোন। আরেকটি গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো: ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলা। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে নির্মাণকাজ, রাস্তার ধুলা ও অন্যান্য উৎস থেকে দূষিত কণার ব্যাপক নিঃসরণের কারণে ঢাকা শহরের বাতাসের গুণমান দ্রুত খারাপ হতে শুরু করে।

ঢাকা দীর্ঘদিন ধরেই বায়ুদূষণ সমস্যায় জর্জড়িত। ঢাকার বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে উন্নত হয়। কিন্তু বর্ষাকালেও ঢাকা আপতিত হয় জলাবদ্ধতার কবলে। নগরীর বহু অংশেই বৃষ্টির পানি জমে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সৃষ্টি করে। থমকে যায় নগরজীবন আর ত্রাহিত্রাহি অবস্থা হয় ঢাকার নাগরিকদের।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা চলে এসেছে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার শীর্ষ সংবাদে। লাগাতার বায়ুদূষণের ধারা ঢাকাতে হাজির করেছে বিশ্বের বিপদজনক ও অস্বাস্থ্যকর শহরের তালিকায়। গত বছরের ২৩শে অক্টোবর ঢাকার বাতাসের গুণমান সূচক (একিউআই) ১৫৯ রেকর্ড করা হয়েছিল। তখন ঢাকাকে বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। একিউআই’র এ মান অনুযায়ী পরিস্থিতি খারাপ হতে হতে ঢাকা এখন পরিণত হয়েছে বিশ্বের শীর্ষতম দূষিত শহরে।

অতীতে বহু শহর পরিত্যক্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে নানা কারণে। রাহুল সাংকৃত্যায়ন প্রাচীন ভারতের সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনায় এমন বহু শহরের বিবরণ দিয়েছেন, যেগুলো আগুন, পানি প্রভৃতির প্রকোপে কিংবা যুদ্ধ ও হানাহানির কারণে বিরাণ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানেও যুদ্ধ ও সংঘাতে মধ্যপ্রাচ্যের বহু ঐতিহ্যবাহী ও ইতিহাস-প্রসিদ্ধ শহর ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেও বিপদগ্রস্ত বহু জনপদ।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও বিভিন্ন দেশের সরকার নানা পরিকল্পনা ও নীতির মাধ্যমে দূষণ ও ধ্বংসের কবল থেকে শহর-জনপদকে রক্ষায় সদা তৎপর। কিন্তু ঢাকাকে ঘিরে নীরবে যে মৃত্যুঘণ্টা বেজে চলেছে, তা কেউ শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হয় না। 'ঢাকা বাঁচাও' বলে কোনও সম্মিলিত আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না। ঢাকার বায়ুদূষণ, জলস্তরের পতন, জলাবদ্ধতা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, যানজট, পরিবেশ বিপর্যয়, সবুজ নিধন ইত্যাদির বিরুদ্ধে শক্ত কোনও পদক্ষেপই চোখে পড়ে না। বরং যে যার মতো ফ্রি-স্টাইলে ঢাকাকে খাবলে খাচ্ছে।

এই অপধারা চলতে থাকলে প্রকৃতি চরম প্রতিশোধ নেবে। 'প্রাচ্যের রোমান্টিক সিটি' ঢাকা রূপান্তিত হবে জ্বলন্ত দোজখে। সেই দোজখের লেলিহান আগুন থেকে তখন কেউ রক্ষা পাবে না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর