আলোর মানুষ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক ভালো নেই

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম। | 2023-08-27 04:12:11

পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে তরুণদের দূর্বার আন্দোলন ও সংগ্রাম চিরস্মরণীয়। ১৯৭১’র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তারুণ্যের সাহসী অংশগ্রহণ পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর শোষণের অবসান ঘটিয়েছে। আমরা পেয়েছি লাল-সবুজের পতাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের ঠিকানা। পাকিস্তানিদের কাছ থেকে মুক্তির স্বাদ ছিনিয়ে আনতে যারা পিতা-মাতা, ঘর-বাড়ির মায়াকে ছিন্ন করে গিয়েছিল রণাঙ্গণে তাদেরই একজন রংপুরের আব্দুর রাজ্জাক।

একাত্তরে আব্দুর রাজ্জাকের বয়স তখন ১৯ বছর। বাড়ির বড় ছেলে হয়েও পরিবার-পরিজন আর সংসারের চেয়ে দেশটাই যেন অনেক বড় কিছু ছিল তার কাছে। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিয়ত জ্বালাও-পোড়াও, মানুষ হত্যা, মা-বোনের সম্ভ্রমহানির খবরে অস্থির হয়ে উঠেন আব্দুর রাজ্জাক।

দিনমজুর বাবা আব্দুর রহিমের কাছে অনুমতি নিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে চলে যান। জলপাইগুড়ির মুজিব ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন কর্নেল আবদুল বাশারের নেতৃত্বাধীন ৬ নম্বর সেক্টরে। পঞ্চগড়ের চিলাহাটি, দেবীগঞ্জ, নীলফামারীর ডোমার-ডিমলাসহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন।

কখনও একবেলা ভাত জুটলেও অনেক সময় না খেয়ে অথবা এক টুকরো রুটি খেয়েই দিন পার করতে হয়েছে। পাকহানাদারদের আস্তানায় হানা দিতে পথ হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। পেটের ক্ষুধার চেয়ে যেন বড় ক্ষুধা ছিল একটি স্বাধীন বাংলাদেশের, একটি স্বাধীন পতাকার ক্ষুধা। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরেও যেন স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন দেশ।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘ভারতের জলপাইগুড়িতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর মোজাফ্ফর হোসেন, অপিল উদ্দিন, গোলামসহ আমরা বেশ কয়েকজন সহযোদ্ধা রাতের আঁধারে নীলফামারীতে চলে আসি। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে পাকিস্তানি সেনাদের দখলে থাকা নীলফামারী, চিলাহাটি, ডিমলা, ডোমার, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জসহ বিভিন্ন থানায় আক্রমণ চালাই।’

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘দিনাজপুরের চিলাহাটি মুক্ত করতে গিয়ে আমাদের একটানা ১৫ ঘণ্টা খালি পেটে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করতে হয়েছিল। আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত পাকিস্তানিরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বৃষ্টির মতো গুলি ও শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ওই সময় পাকিস্তানি সেনাদের নিক্ষেপ করা একটি গুলি আমার মাথার খুব কাছ দিয়ে চলে যায়। একটি বোমার শেলও আমার পাশে বিস্ফোরিত হয়। আমি ঝাঁপ দিয়ে একটি গর্তে গিয়ে পড়ি। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলি ও গ্রেনেডে আমার বন্ধু মোবারক হোসেনসহ তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অনেকে আহত হন। ওই সময় আমাদের মনোবল কিছুটা ভেঙে যায়। এক পর্যায়ে আমরা পিছিয়ে সীমান্তবর্তী এলাকায় চলে আসি এবং পরে আবার আক্রমণ চালিয়ে এলাকাটিকে শত্রুমুক্ত করি।’

অপ্রতিরোধ্য গতিতে যুদ্ধ ও বিজয় অর্জনের পথে ডিসেম্বর মাসে নীলফামারীর সৈয়দপুরের কাছাকাছি এলে দেশ স্বাধীন হয়। এরপর আব্দুর রাজ্জাকসহ তার সহযোদ্ধারা নীলফামারীতে অস্ত্র জমা দেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রংপুরে জনসভা করতে আসেন। এ সময় রংপুর সার্কিট হাউসে স্বেচ্ছাসেবক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রাজ্জাককে তার দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজ্জাক বলেন, ‘আমার ব্যবহার ও আচরণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আমাকে পুনর্বাসনের ঘোষণা দেন। পরে বিপথগামী সেনাবাহিনীর কয়েক সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হলে আমার সে আশা ভেস্তে যায়।’

মুক্তিযুদ্ধ আর জীবনযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে কাছে এভাবেই আবেগ-অনুভূতি তুলে ধরেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক।

এরপর জীবনযুদ্ধ শুরু হয় আব্দুর রাজ্জাকের। ইলেক্ট্রিশিয়ান হিসেবে তিনি রংপুর টাউন হল এলাকায় মঞ্চ সাজানোর কাজ বেছে নেন। বয়স হয়েছে, দৃষ্টিশক্তিও কমে এসেছে তার। তবু স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানকে নিয়ে জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখার সংগ্রাম করে চলেছেন তিনি। তিনি জানান, দেশ স্বাধীনের পর ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ বেছে নেন। নাটকের লাইটিংয়ে বেশ সুমানের সাথে কাজ করতে থাকেন তিনি।

ইলেক্ট্রিশিয়ানের পাশাপাশি তার নৈশ্যপ্রহরী পদে তার চাকরি জোটে রংপুর শিল্পকলা একাডেমিতে। স্ত্রী, ৬ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে দিনের সময়টাতে রংপুর টাউন হলে নাটকসহ বিভিন্ন আয়োজনের আলোকসজ্জার কাজ আর রাতে নৈশপ্রহরীর চাকরি করেন। দুর্ঘটনায় এক ছেলে ও একমাত্র মেয়েকে হারানোর পর টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে ক্যান্সারে আক্রান্ত আরও এক ছেলেকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেন।

মুক্তিযুদ্ধের এ বীরসেনা জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে একটা সময় হাঁপিয়ে উঠেন। বয়সের ভারে ক্লান্ত হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন। বড় ছেলে আলমগীর এখন তার বাবার পেশাটাই আগলে ধরে দিনরাত কাজ করছেন। বাকি তিন ছেলের মধ্যে একজন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এবং অন্যজন গঙ্গাচড়ার একটি ইউনিয়নের ভূমি অফিসে অফিস সহকারী পদে কাজ করছেন।

বর্তমানে আব্দুর রাজ্জাক রংপুর মহানগরীর গোমস্তপাড়া সংলগ্ন শ্যামা-সুন্দরী খালের ওপর খাস জমিতে ছাপড়া ঘর তুলে কোনোরকমে রাতটা কাটিয়ে দেন। আর দিনের সময়টা কাটে চিরচেনা টাউন হল চত্বরে নতুবা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে। সেখানে কাগজ কলম হাতে নাট্যজনদের সাথে গল্প-আড্ডায় যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার চেয়ে তার লেখা নাট্যাংশ পড়ে শোনান অন্যদের। আবার কখনো কখনো সুযোগ পেলেই ছুটে যান গঙ্গাচড়ার বড়বিল ইউনিয়নের পানাপুকুর গ্রামে। সেখানে স্ত্রীর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া একখন্ড জমিতে তার স্ত্রী, ছেলে ও অন্য স্বজনরা থাকেন।

তার ছেলে আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বাবা আগে টাউন হলে লাইটিংয়ের কাজ করতেন। এখন বয়স হওয়ায় তা আর করতে পারেন না । ওই কাজ আমি করি। টাউন হল এলাকায় কোনো অনুষ্ঠান হলে আমি আলোকসজ্জার কাজ করে যে টাকা পাই তা দিয়েই আমাদের সংসার চলছে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর