আড়তদারের কাছে জিম্মি ফেনীর পেঁয়াজের বাজার

, জাতীয়

মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা-২৪.কম, ফেনী | 2023-12-10 11:38:09

প্রতিবেশী দেশ ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই এক লাফে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম বেড়ে ২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। সঙ্গে বেড়েছে দেশি পেঁয়াজের দামও। বিকল্প হিসেবে বাজারে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে মিশরীয় পেঁয়াজ।

খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ধারণা, আগামী দুই দিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম ২৫০ টাকা বা তারও বেশি হতে পারে। এতে ফের ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা। খুচরা ব্যবসায়ীদের মতে ফেনীর আড়তে পেঁয়াজ নেই এটা অবিশ্বাসযোগ্য, পাইকাররা বলছেন পেঁয়াজের সাপ্লাই বন্ধ। ফলে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। সাধারণ মানুষ বলছেন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে টাকা লুটপাটের পাঁয়তারা করা হচ্ছে। তাদের মতে একপ্রকার আড়তদারদের নিকট জিম্মি ফেনীর পেঁয়াজের বাজার।

ফেনী বড় বাজার ঘুরে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফেনী বড় বাজারে খুচরা পর্যায়ে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি আড়ত থেকে পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ করে রাখা হয়েছে যার ফলে ১০ থেকে ২০ কেজি করে কিনে বিক্রি করছেন তারা।অন্যদিকে পাইকারি আড়তদারদের দাবি ফেনীর বাজারে কোন পেঁয়াজ আসেনি। যার ফলে বাজারে পেঁয়াজ নেই। তবে বেশিরভাগ খুচরা ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন বড় বড় আড়তগুলো সিন্ডিকেট করে ইচ্ছাকৃতভাবে পেঁয়াজ বিক্রি বন্ধ রেখেছেন যাতে বাজারে সংকট তৈরী হলে বেশি দামে বিক্রি করতে পারে।


বাজার ঘুরে জানা যায়, শুক্রবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহে ছিল ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। এছাড়াও দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা কেজি দরে, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৩০ টাকা। তবে শুক্রবার সন্ধ্যার পর পেঁয়াজের দামে ভেলকি দেখান বিক্রেতারা। তখন ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকা দরে এবং দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১৭০ টাকা কেজি দরে।

ফেনী বড় বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী রমনী সাহা স্টোরের স্বত্বাধিকারী মিন্টু সাহা বলেন, কোন আড়ত পেঁয়াজ বিক্রি করছেনা। খুচরা ব্যবসায়ীরা নিরুপায়। ভারত পেঁয়াজ বন্ধ করলেও দেশে যে পরিমাণ পেঁয়াজ মজুদ আছে তা দিয়ে একমাস চলা সম্ভব। কিন্তু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারণে খুচরা ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা সমস্যায় পড়ছেন।

তিনি বলেন, ক্রেতারা দাম বাড়বে শুনলে আরও বেশি কিনে। এ সুযোগ নিয়ে বড় ব্যবসায়ীরা দাম আরও বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আড়তগুলো সাপ্লাই বন্ধ রাখাতে খুচরা ব্যবসায়ীদের ১ থেকে ২ বস্তা নিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। বাজার একদমি স্থিতিশীল নেই। সকালে ১৭০ টাকা বিক্রি করলেও সন্ধ্যা নাগাদ ২০০ হয়ে গেছে। দেশীয় পেঁয়াজ বাজারে নেই বললেই চলে।

মডার্ন ট্রেডার্স এর ফখরুল ইসলাম সবুজ বলেন, আমাদের ১০ থেকে ২০ কেজি কিনে বিক্রি করতে হচ্ছে। আড়তদাররা কোন মেমো দিচ্ছেন না। বড় বড় আড়তগুলো বলছে তাদের কাছে পেঁয়াজ নেই আমরা খুচরা ব্যবসায়ীরা নিরুপায়। আমার প্রতিদিন ২০ বস্তা লাগলেও আজকে ২০ কেজি কিনে বিক্রি করছি। অনেক ক্রেতা দাম শুনে চলে যাচ্ছে।


তিনি বলেন, আমি গতকাল বিক্রি করেছি ৯৮ থেকে ১০০ টাকা। আজকে এক লাফে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা। সিন্ডিকেট করে বড় ব্যবসায়ীরা এক সপ্তাহে ক্রেতার পকেট থেকে সব টাকা নিয়ে যাবে। বিপাকে পড়ব আমরা খুচরা ব্যবসায়ীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক খুচরা বিক্রেতা বলেন, ফেনী বড় বাজারের হরিপদ স্টোর, ভক্তিপদ স্টোরে পেঁয়াজ নেই এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। আরও ৩০ দিন চলার মতো পেঁয়াজ দেশে আছে কিন্তু কেউ বিক্রি করছে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বড় বাজারের একজন কমিশন এজেন্ট বলেন, প্রতিদিন ফেনীতে ১০০ টন পেঁয়াজ আসে। ফেনীতে ১৪ জন বড় আড়ৎদার রয়েছে। এদের মধ্যে হরিপদ স্টোর, ভক্তিপদ স্টোর, পিটুল সাহা, দোয়েল এন্টারপ্রাইজ অন্যতম। দাম বাড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, বুধবার থেকে কোন গাড়ি ফেনীতে আসতেছে না। প্রতিদিনের পেঁয়াজ প্রতিদিন বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। কোন মজুদ নেই। কারও কাছে ১০০ থেকে ২০০ বস্তা থাকতে পারে তবে কারও কাছে অতিরিক্ত মজুদ নেই। তিনি বলেন, পোর্টে মঙ্গলবার থেকে বার বার বলা হয়েছে পেঁয়াজ দেয়ার জন্য কিন্তু দেয়নি।

অভিযোগের বিষয়ে ফেনীর বড় আড়তদার মেসার্স হরিপদ স্টোরের স্বত্বাধিকারী হরিপদ সাহা বলেন, আমরা মজুদ রেখেছি এটা অসত্য ও ভিত্তিহীন কথা। গুজবে কান দিয়ে লাভ নেই। আমার কাছে কোন পেঁয়াজ ই নাই, আমি বিক্রি করব কিভাবে।

তিনি বলেন, ফেনীতে দৈনিক ১০০ টন পেঁয়াজ আসে। কিন্তু গতকাল কোন পেঁয়াজ ই আসেনি। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়াতে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলেন ১ দিন চলার মতো পেঁয়াজ দেশে নেই। যার ফলে আজকে সাপ্লাই বন্ধ, বাজারে সংকট তৈরি হওয়াতে দাম বেশি।  ব্যবসায়ীদের কোন সিন্ডিকেট নেই।

উল্লেখ্য, মূলত নিজেদের দেশের বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ভারত সরকার আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করার খবর পৌঁছে যায় সাধারণ ব্যবসায়ীদের কানে। এরপরই নিজ নিজ অবস্থান থেকে বাড়তি দামে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেন তারা।

পেঁয়াজ থাকলেও বিক্রি করছেন না আড়তদাররা

ফেনী তাকিয়া রোডের পেঁয়াজের আড়ত মেসার্স হাজী হারুন সওদাগর। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় আড়তে রয়েছে বেশ কয়েক বস্তা পেঁয়াজ। কিন্তু বার্তা২৪.কম-এর প্রতিবেদকসহ সাংবাদিকদের উপস্থিতি দেখে তিনি বললেন এসব পেঁয়াজ ৪ দিন আগে বিক্রি হয়ে গেছে। এখন ডেলিভারির অপেক্ষায় রয়েছে। কিন্তু বিক্রির কোন মেমো দেখাতে পারেন নি তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ম্যানেজার মোঃ শাকিল বলেন, পেঁয়াজের বস্তাগুলোর সামনে দিয়ে আলু থাকার কারণে এগুলো বিক্রি হয়নি। এখন আলু বিক্রি হয়েছে এবার পেঁয়াজ বিক্রি হবে।

পেঁয়াজ নিয়ে আড়তদারদের মধ্যে চলছে লুকোচুরি। খুচরা ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে আছে তাদের কাছে। বাজারে পেঁয়াজ না থাকায় বেশি দামে পেঁয়াজ কিনে বিপাকে পড়ছেন সাধারণ ক্রেতারা। তারা বলছেন ১ দিনে ১০০ টাকা বেড়ে যাওয়া ইতিহাসে নজিরবিহীন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর