বন্দী দরজার শিকল ভেঙে একটু স্বাধীনতার স্বাদ পেতে কে না চায়। বিজয় কথাটি শুনলেই শরীর জুড়ে বয়ে যায় আনন্দের ঢেউ। বিজয় মানে মুক্তি, শেকল ছেঁড়া স্বাধীনতা। পরাধীনতার গ্লানি দূর করে আনন্দ, বেদনা আর গৌরব মিশ্রিত অর্জন এই বিজয়।
বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, নানা বিসর্জন আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া এই লাল সবুজের পতাকা। বাঙালির জীবনের আনন্দঘন ও গৌরবোজ্জ্বল দিন ১৬ ডিসেম্বর, মহান বিজয় দিবস।
বিজয় রক্তে গাঁথা এক বেদনাদায়ক ইতিহাসের সমাপ্তির দিন। স্বাধীনতার লিপ্সায় মত্ত ৩০ লাখ শহিদের রক্তে অর্জিত বিজয়। যা আমাদের গৌরব ও অহংকারের সঙ্গে বাঁচতে শেখায়। শত বছরের শত সংগ্রামের একটি বড় পাওয়া প্রিয় স্বাধীনতা, লাল সবুজের পতাকা। এ বিজয়ের মাধ্যমে বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশসহ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন।
মুক্তি পাগল বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার রক্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে বলে একদিন অস্ত্র কাঁধে তুলে নেয়। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার সবাই শরিক হয়ে থাকে এ লড়াইয়ে। যতই দিন অতিবাহিত হতে থাকে আরও শানিত হয় প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র। লক্ষ্য স্থির রেখে শত্রু হননের দৃঢ়তায় এগিয়ে যায় বীর বাঙালি। বাঙালির এই স্বাধিকার আন্দোলনের দৃঢ়চেতা ভাব স্পষ্ট করে তোলে আন্তর্জাতিক সমর্থন। প্রতিবেশী ভারতেও জড়িয়ে পড়ে বাঙালির ভাগ্য যুদ্ধ।
দীর্ঘ নয় মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে বাঙালি জাতির জীবনে আসে নতুন ভোর। প্রভাতের রক্তিম সূর্যের ন্যায় লাখো শহিদের রক্তের প্রতিদান স্বরূপ আসে হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সূচিত হয় মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য বিজয়। বাঙালি জাতি এদিন অর্জন করে তার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার। ত্রিশ লাখ শহিদের রক্ত আর লাখ লাখ ধর্ষিতা মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বিজয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ধরা দেয় বাঙালির জীবনে।
বিজয় প্রাপ্তির ৫৩ বছর আজ। সময়ের পরিক্রমায় বিষাদের হাওয়া বইতে বইতে অনুভূতি ফিকে হয়ে আসে আমাদের। বাতাসে মানুষের রক্তের গন্ধ, শ্বাস-প্রশ্বাসে হাহাকার আর বাঙালির আত্মত্যাগের ভাগ্যযুদ্ধ বিজয়ের সাক্ষী হয়ে আছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দাঁড়িয়েও শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তি পাওয়া এই দেশে প্রত্যাশার জায়গা আজ নড়বড়ে। নড়বড়ে আজ মানুষের জীবনের ভিত। উন্নয়নের জোয়ার জনজীবনে কতটা অবদান রাখছে, স্বাধীনতা কতটা বহাল থাকছে, সেদিকে আমাদের দৃষ্টির প্রখরতা নেই। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ মুখ থুবড়ে পড়ছে। দুর্নীতির করাল গ্রাসে জাতির জীবন আজ দুর্বিষহ। দিনটি সবার জন্য সমান গুরুত্ব নিয়ে আসলেও সেই কাঙ্ক্ষিত সমান সুযোগ-সুবিধা আজও নিশ্চিত হয়নি।
বিজয় অর্জনের পর অর্ধ-শতাব্দী পার হয়েছে। এর মধ্য অনেক চড়াই উতরাই অতিক্রম করেছে। রদবদল হয়েছে ক্ষমতা। সংকীর্ণ এই সময়ে সৃষ্টি হয়েছে পাওয়া-না পাওয়ার অনেক গরমিল। তবুও হাজার বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ভবিষ্যতে প্রত্যাশিত সোনার বাংলা পেতে আশাবাদী সবাই। সৃজনশীলতার ছোঁয়ায় সৃষ্টি হবে এক নন্দিত সমাজ, পথচলা হবে গৌরবের; এই প্রত্যাশায় প্রতিদিন ভোর হয়, ওঠে নতুন সূর্য। বিজয়ের প্রত্যয় ধরে রেখে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আমাদের দৃষ্টিপাত করতে হবে। মুক্তির শিকল কারো ছেঁড়া আর কারো পায়ে বাঁধা থাকবে না। বিজয় হবে সকল পেশা, সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সমান।
সমাজের কাছে আমরা প্রত্যেকেই দায়বদ্ধ। দেশ যেমন আমাদেরকে শান্তির শিখরে বাঁচতে দিচ্ছে, তেমনি আমাদেরও রয়েছে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা। রয়েছে ঋণ পরিশোধের দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য। ক্ষুধার্তকে খাদ্য এবং অজ্ঞকে জ্ঞানের আলো দিয়ে এই স্বাধীনতাকে সার্থক করে তুলতে কাজ করতে হবে আমাদের সকলের। বিজয়ের মর্ম রক্ষায় সকল বিভেদ-বিচ্ছেদ ভুলে, হানাহানি ও সংঘাত দূর করে, সংকীর্ণ স্বার্থপরতা জলাঞ্জলি দিয়ে দেশ গড়ার কাজে ব্রতী হই। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষা করে এবং সেই আদর্শের ভিত্তিতে যাতে দেশটি গড়ে ওঠে, সে জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অক্ষুণ্ন রাখতে হবে।