প্রধান ফটকের বাইরে আগের মতো দালালদের আনাগোনা না দেখা গেলেও ভেতরের কর্মকর্তারা এখন অনেকটা দালালের ভূমিকা পালন করে চলেছেন। সেবাগ্রহীতাদের সেবা দেয়ার বদলে নিজেদের ফায়দা হাসিলে ব্যস্ত থাকেন তারা। তাদের নিয়ম না মেনে কাগজপত্র জমা দিতে গেলে বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে ফিরিয়ে দেন। অথচ ভেতরে থাকা কিছু কর্মকর্তার কাছে গেলে সেই কাজ করে দেন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার চুক্তিতে। এমনটাই ঘটছে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে। যার মূল নিয়ন্ত্রণ দায়িত্বরত আনসার সদস্যদের হাতে।
সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসে প্রতিদিন বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকেই আসেন পাসপোর্ট তৈরি করতে। কিন্তু বিভাগীয় এই অফিস এখন যেনো ভোগান্তির অপর নাম। পাসপোর্টের আবেদনপত্র নিজে পূরণ করে তা জমা দিতে গেলেন তো বিপাকে পড়লেন। কিছু না দেখেই আরও কাগজ-পত্র লাগবে বলে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ফরমে বিশেষ সাংকেতিক 'চিহ্ন' থাকলে তা যাদুর মতো কাজ করে। তখন আর কিছুই লাগে না সেখানে।
কারণ খুঁজে জানা গেছে পকেটে অর্থ ঢুকে গেলেই সব ঠিক। সিলেট পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়।
সেই অভিযোগের সূত্র ধরে মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে গ্রাহক সেজে সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে যান এই প্রতিবেদক। অফিসে ঢোকার আগেই পাসপোর্টের আবেদনপত্র নিজে পূরণ করে অনলাইনে ফি পরিশোধ করেন তিনি। পরবর্তীতে পাসপোর্ট অফিসের ফরম জমা দেওয়ার ১০৮ নাম্বার কাউন্টারের সামনে যান। সেখানে দায়িত্বে থাকা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা তখন দুলাভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন (আলাপচারিতা থেকে বোঝা যায়)। প্রায় ১৫ মিনিট মোবাইলে কথা বলা শেষ করে ফরম না দেখেই বিভিন্ন কাগজপত্র নেই এমন অযুহাতে আবেদনপত্র ফিরিয়ে দেন। বললেন, আপনার কাগজপত্র ঠিক নেই। ঠিক করে নিয়ে আসেন তখন কাগজ জমা নিবো।
সেখান থেকে ফিরে এলে এই প্রতিবেদককের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে আসেন মূল ফটকের দায়িত্বে থাকা পলাশ নামে এক আনসার সদস্য। সরাসরি জানালেন আড়াই হাজার টাকার বিনিময়ে বিষয়টি সুরাহা করতে পারবেন। দরকষাকষি শুরু করেন প্রতিবেদক। অবশেষে ২ হাজার টাকায় রফাদফা হয়। এরপর প্রত্যাখ্যাত হওয়া কাউন্টারে ফের গিয়ে নিমিষেই সিল ছাপ্পর মেরে আবেদন ফরমে ই-মেইলের স্থানে বিশেষ সাংকেতিক চিহ্ন বসিয়ে দেন তিনি। এরপর ১০৩ নাম্বার রুমে গিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ছবি দিতে বলেন আনসার সদস্য পলাশ। এখানে দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্য পলাশ বললেন সেখানে দুলাল ফরাজী নামের আরেক আনসার সদস্য তাকে সহোযোগিতা করবেন। বিশেষ সাংকেতিক চিহ্নর জন্য এই পাসপোর্ট করতে প্রতিবেদক ২ হাজার টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তার পথ আটকে দিয়ে পিছু নেন আনসার সদস্য দুলাল ফরাজী ও পলাশ। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে মূহুর্তেই সবকিছু অস্বীকার করেন দুজন। পরে মোবাইল ফোনে থাকা প্রমাণ দেখালে চুপসে যান তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের আশেপাশে গড়ে উঠা ১০-১২টি কম্পিউটার দোকান ও শহরের বিভিন্ন মার্কেটের অন্তত কয়েকশত নাম-বেনামের ট্রাভেলস এজেন্টরা পাসপোর্ট তৈরি ও নবায়নের কাজ অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কাজ করিয়ে দেন। এসব দোকান ও এজেন্টদের গিয়ে পাসপোর্ট তৈরির কথা বললেই তারা নির্ধারিত ফি'র চেয়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা বেশি টাকা নিয়ে পাসপোর্টের কাজ করেন।
পাসপোর্ট অফিসের সিটিজেন চার্টারের তথ্য অনুযায়ী, ৪৮ পৃষ্ঠার এবং পাঁচ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৪ হাজার ২৫ টাকা (বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫% ভ্যাটসহ) ফি জমা দিতে হবে। এই পাসপোর্ট পেতে ১৫ থেকে ২১ দিন অপেক্ষা করতে হবে। আর জরুরি পাসপোর্ট করতে লাগবে ৬ হাজার ৩২৫ টাকা, আর এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৭ থেকে ১০ দিন। অন্যদিকে ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে অতীব জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এ ছাড়া ৪৮ পৃষ্ঠার এবং ১০ বছর মেয়াদসহ নিয়মিত পাসপোর্ট করতে ৫ হাজার ৭৫০ টাকা লাগবে। এই পাসপোর্ট পেতে অপেক্ষা করতে হবে ১৫ থেকে ২১ দিন। আর ৭ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে জরুরি পাসপোর্ট পেতে চাইলে ফি দিতে হবে ৮ হাজার ৫০ টাকা। এর বাইরে অতীব জরুরি পাসপোর্ট ১ থেকে ৩ দিনের মধ্যে নিতে চাইলে শুধু ফি গুণতে হবে ১০ হাজার ৩৫০ টাকা।
পাসপোর্ট অফিসের ১০৮ নাম্বার কাউন্টারে আবেদনপত্র প্রত্যাখান হওয়া আহমদ হোসেন বাপ্পি নামের একজন আবেদনকারী বলেন, আমি নিজে নিজে আবেদনপত্র পূরণ ও পেমেন্ট শেষ করে এখানে আসার পর তারা আমার কাগজপত্র সংকট দেখিয়ে জমা নেননি। আমি বুঝতে পেরেছি আমি তাদের পথ অনুসরণ করে আসিনি তাই এরকম হচ্ছে। দেখি যদি না হয় তবে তাদের সিস্টেমে আমিও আসবো। কারণ আমার বিদেশ যেতে হলে পাসপোর্ট দরকার।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মহের উদ্দিন শেখ’র সঙ্গে। তিনি বলেন, বিশেষ সাংকেতিক চিহ্নের বিষয়টি আমার জানা নেই। আমরা সকলকেই সমানভাবে সেবা দিয়ে থাকি।প্রতিদিনের আবেদন প্রতিদিনই শেষ করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। কাগজপত্র ঠিক নেই বলে প্রত্যাখ্যান হওয়া ১০৮ নাম্বার কাউন্টারে টাকা দিলে তা কিভাবে তা গ্রহণ করা হয় এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। বললেন, আমাকে একটু সময় দেন আমি এ বিষয়ে কাজ করছি। এরকম কাউন্টারে হলে তাকে আমরা সরিয়ে দিবো। প্রধান ফটকের ভেতরে দালালের ভূমিকায় আনসার বাহিনীর সদস্য পলাশ ও দুলাল ফরাজীর ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এই ধরনের অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো। তাদেরকে এমনিতেই ছয় মাসের বেশি আমরা পাসপোর্ট অফিসে রাখিনা। পর্যায়ক্রমে তাদের অদলবদল হয়।