শীতের সকালে দ্রুতগতির পথচারিদের কানে এসেছে কিচিরমিচির শব্দ। উত্তরের তীব্র হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করেই এক ঝাঁক পাখি ডানা মেলে এসেছে এ শহরে। যান্ত্রিক কোলাহল আর ইট পাথরের শহরে তখনো শুরু হয়নি জনমানুষের কর্মব্যস্ততা। এ শহরেই এখন এরা নতুন অতিথি।
‘পাতি সরালি’ ভিন্ন জায়গা থেকে উড়ে এসে জায়গা করে নিয়েছে পাবনা শহরের নয়নামতি এলাকার পাশ দিয়ে অবস্থিত কচুরিপানা পূর্ণ এক জলাশয়ে। পথচারিরা যাবার সময়ে হঠাৎ পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। ওড়াওড়ি, ছুটোছুটি, খুনসুটি আর মনের সুখে সাঁতার খেলায় ব্যস্ত থাকে এক ঝাঁক পাতি সরালি পাখি।
স্থানীয়রা জানায়, পাবনা শহরের নতুন অতিথি এখন তারা। অন্য এলাকা থেকে উড়ে আসা এই পাখির নাম পাতি সরালি। অতিথি আগমনের এই মনোরম দৃশ্যের দেখা মিলছে পাবনা পৌর শহরের ১২ নং ওয়ার্ডের নয়নামতিতে।
তারা আরও জানায়, যান্ত্রিক শহরে এখন এই নতুন অতিথিদের কোলাহলেই ঘুম ভাঙছে তাদের। তাদের মতে, গেল মঙ্গলবার (৭ জানুয়ারি) পাখিগুলো এই শহরে অবস্থান করেছে। তবে পাতি সরালিরা ঠিক কবে নাগাদ এ শহরে এসেছে এটা তাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীতকালে বাংলাদেশে যে সকল পাখি দেখা যায় তার মধ্যে এই পাতি সরালি অন্যতম। এটি ছোট সরালি বা গেছো হাঁস নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Lesser Whistling Duck বৈজ্ঞানিক নাম Dendrocygna javanica। এটি মূলত দেশি বা আবাসিক পাখি। তবে শীতকালে লোকালয়ে দলবদ্ধভাবে এদের দেখা মেলে। এজন্য অনেকেই একে পরিযায়ী পাখি ভেবে ভুল করে। দেশি পাখি হলেও শীতকালে ভারত, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে উড়ে এসে এদেশে আবাস গড়ে তোলে এই পাখি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার বড় বড় দালান। মাঝে ছোট্ট একটা জলাশয়। কচুরিপানাপূর্ণ এই জলাশয়েই নির্ভয়ে ঘুরছে এক ঝাঁক পাখি। কেউ সাঁতার কাটছে, কেউ অন্যের সঙ্গে খুনসুটিতে মেতেছে। একটু পর পর কিছু পাখি উড়ে জায়গা পরিবর্তন করছে। সামান্য শব্দ হলেই উড়ে যাচ্ছে দল বেঁধে। ওদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত পুরো এলাকা। বাড়ির ছাদ বা বারান্দা থেকেই এলাকাবাসীরা উপভোগ করছে সেই মনোরম দৃশ্য।
পাখি দেখতে গিয়ে কথা হয় এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আব্দুলাহ শাফির সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকায় অতিথি পাখির সমাগম ঘটলেও পাবনা শহরে এবারই প্রথম এদের বিচরণ দেখলাম। শহরের যান্ত্রিক শব্দের বদলে এখন সকালে ঘুম ভাঙে ওদের কোলাহলে। ওরা যেন নিরাপদে এখানে থাকতে পারে তার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। পাখি শিকারি বা বাইরের কারো দ্বারা ওদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সে বিষয়টি নিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
পাবনা বন্য প্রাণি সংরক্ষণ আন্দোলন কমিটির আহ্বায়ক ও আলোকচিত্রী এহসান আলী বিশ্বাস জানান, এই পাখি দেশি প্রজাতির হলেও পাবনার জন্য তারা অতিথি ও দেশীয় সম্পদ। পাখি শিকারের বিরুদ্ধে সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রচারণা বৃদ্ধির পাশাপাশি আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে এই সম্পদ রক্ষা করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘শীতের এই সময়ে পাবনার বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর পরিমাণে অতিথিসহ দেশি পাখির বিচরণ ঘটে। তাদের নিরাপত্তার জন্য আমরা রাজশাহী বন্যপ্রাণি বিভাগ ও পুলিশের সহায়তায় মাঝে মাঝেই শিকার বিরোধী অভিযান পরিচালনা করি। তবে লোকবলের অভাবে এটা সব সময় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।’
পাখি পর্যবেক্ষক ও কুষ্টিয়া বার্ড ক্লাবের সভাপতি এস আই সোহেল জানান, পাতি সরালি নিশাচর স্বভাবের আবাসিক পাখি। দিনে জলমগ্ন ধানক্ষেত ও বড় জলাশয়ের আশপাশে দলবদ্ধভাবে জলকেলি আর খুনসুটিতে ব্যস্ত থাকলেও রাতে খাবারের সন্ধানে চরে বেড়ায়। এদের প্রধান খাবার পানিতে থাকা গুল্ম জলজ উদ্ভিদ, শস্যদানা, ছোট মাছ, ব্যাঙ, শামুক, কেঁচো ইত্যাদি।
তিনি জানান, পাখিটির মাথা, গলা ও বুক বাদামি, কালো পা এবং ঠোঁট ধূসর-কালচে রঙের। পিঠে হালকা বাদামির ওপর নকশা আঁকা ও লেজের তলা সাদা। পুরুষ ও স্ত্রী পাখি দেখতে একই রকম। প্রজনন মৌসুমসহ অন্য সময় এরা জুটি বেঁধে পৃথকভাবে দুর্গম বিল-হাওরে বসবাস করে। তাই শীত ব্যতীত এদের একত্রে বেশি দেখা যায় না। পাতি সরালির ওজন প্রায় ৫০০ গ্রাম, দৈর্ঘ্য ৪৫ সেন্টিমিটার। সাধারণত এদের ডানা ১৮.৭ সেন্টিমিটার, ঠোঁট ৪ সেন্টিমিটার এবং লেজ ৫.৪ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে।