উপকূলের ‘সিঙ্গেল মাদার’ হিসেবে স্বীকৃত সংগ্রামী নারীদের অনেকেই পরিবারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারা একাই সন্তান লালন পালন করেন। এদের কারোর স্বামী মারা গেছেন, আবার কারোর স্বামী তাকে ছেড়ে গিয়ে অন্যত্র বিয়ে করেছেন। এদের কেউ কেউ দালালের খপ্পরে পড়ে বিদেশেও পাচার হয়েছেন। আবার কেউ স্বামী হারিয়ে পেয়েছেন ‘স্বামীখেকো’ বা ‘অপয়া' উপাধি। কারোর স্বামী দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত। উপকূলের এমনই দুই সংগ্রামী নারী সোনামনি দাসি (৬৫) ও শেফালী বিবি (৫৫)।
সোনামণি দাসি। বয়স প্রায় ষাটোর্ধ্ব ছুঁই ছুঁই। তিনি স্বামী হারিয়েছেন বলে সমাজ থেকে পেয়েছেন ‘স্বামীখেকো’ ও ‘অপয়া' উপাধি।
তিনি বার্তা২৪.কম’কে বলেন, ‘ছোটবেলায় আমার বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনে মাছ শিকারে গেলে স্বামীকে প্রাণ দিতে হয় বাঘের আক্রমণে। একমাস বয়সী শিশুসহ স্বামীর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় শাশুড়ি। সমাজ আমাকে ‘অপয়া' বলে আখ্যা দেয়। মনে হলো দোষ সবই আমার। যেন আমার অপরাধের কারণে স্বামীকে বাঘে নিয়েছে। এভাবে দিন যেতে থাকে। কিছুদিন পরে দেবরের সঙ্গে বিয়ে হয় আমার। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ২০০২ সালে দ্বিতীয় স্বামীও সুন্দরবনে মাছ শিকরে গেলে তাকেও বাঘের আক্রমণে প্রাণ দিতে হয়। দুই স্বামী বাঘের পেটে যাওয়ার পর আমাকে ‘স্বামীখেকো’ উপাধি দেওয়া হয়। তখন সমাজে চলাফেরাই আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। সমাজ আমাকে অপয়া, অলক্ষ্মী বলে আখ্যা দেয়। শাশুড়ি আমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন, যাতে সকালে ঘুম থেকে উঠে আমার মুখ দেখতে না হয়। শুরু হয় আমার একাকী জীবন।এভাবে চলতে থাকে দিন।’
সোনামনির প্রথম স্বামীর একটি সন্তান ও দ্বিতীয় স্বামীর তিনটি সন্তান। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে মেয়েরা সবাই বিবাহিত এবং আলাদা আলাদা। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই মাকে তারাও দেখে না।
বর্তমানে সংসার কিভাবে চলে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘ আমার আর সংসার! আমি একলা! বাজারের দোকান ঝাড়– দেই, নদীতে জাল টেনে মাছ-কাঁকড়া ধরি, ঘেরে মাটি কাটার কাজ করি। যখন যে কাজ পাই তা করি। এভাবে চলতিছে। এভাবে ছেলে মেয়েদের একাই লালন পালন করে বড় করেছি। এভাবেই চলছে জীবন।’
শুধু সোনামণি দাসি নয় এমন সংগ্রামী জীবনের আরেক নারী শেফালী বিবি (৫৫)। তিনি সুন্দরবনঘেঁষা দাতিনাখালী গ্রামের ছবেদ আলী গাজীর স্ত্রী। স্বামী থেকেও সিঙ্গেল মাদার এ নারীই পরিবারের প্রধান। স্বামী দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হওয়ায় একাই সংগ্রাম করে সংসারকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
তিনি বার্তা২৪.কম’কে বলেন, ‘আমাদের এক টুকরো খাসজমিতে ছয় জনের বাস। স্বামী দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। কি করবো কোথায় যাবো কিভাবে সংসার চালাবো এ নিয়ে মাথায় চিন্তা। তাই নিজেই কিছু করার কথা ভাবতে থাকলাম। একপর্যায়ে উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বারসিকের পরামর্শে সুন্দরবনের ফল কেওড়ার টক, ঝাল ও মিষ্টি আচার, জেলি এবং চকোলেট তৈরি শুরু করি। একই সঙ্গে মোম দিয়ে শোপিস, মোমবাতিসহ বিভিন্ন পণ্য বানিয়ে বিক্রি করা শুরু করি। এতেই আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্যের মুখ দেখি আমি।’
তিনি এখন অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারীদের দৃষ্টান্ত। শেফালী শুধু নিজের ভাগ্যের চাকাই ঘুরাননি, সুন্দরবনের সুরক্ষা ও বনজীবীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য উপকূলীয় এলাকার বননির্ভর নারীদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘দাতিনাখালী বনজীবী নারী উন্নয়ন সংগঠন’। শতাধিক নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে করেছেন আত্মনির্ভরশীল। প্রশিক্ষিত এসব নারীও কেওড়ার চকলেট, আচার ও জেলি এবং সুন্দরবনের মধু বয়ামজাত করে বিক্রির মাধ্যমে উপার্জন করছেন অর্থ। এসব পণ্য বিক্রির লভ্যাংশ ব্যয় হচ্ছে ‘বাঘ বিধবা’ ও বনজীবী নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে।
এ বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলা জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মিসেস শাহানা হামিদ বার্তা২৪.কম’কে বলেন, উপকূলের নারীরা যেভাবে সংসারের হাল ধরছেন সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে নারীদের সরকারি সহায়তার মাধ্যমে এসব কাজে আরও উদ্যোগী করা প্রয়োজন। কারণ এরাই অর্থনীতি চাঙ্গা করার মূল হাতিয়ার। উপকূলে নারী জেলে শ্রমিক রয়েছেন এমন তথ্য সরকারের কাছে নেই। তাদের নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার।
তিনি আরও বলেন, উপকূলের নারীরা যেসব কাজে এগিয়ে, তা দেখতে হলে এখানে আসতে হবে। দেশের সামগ্রিক নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে এসব নারী অংশীদার। তাই সরকারের পক্ষ থেকে এসব নারীকে বিনা সুদে ঋণ সহায়তা দেওয়া উচিত।