‘ফরমায়েশি আদালতে’ সাংবাদিকের দণ্ড: তথ্য চাওয়া অপরাধ নয়

, জাতীয়

কবির য়াহমদ,অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-03-10 09:15:40

নিয়ম মেনে তথ্য চাইতে গিয়ে কারাদণ্ড পেয়েছেন এক সাংবাদিক। ছয় মাসের দণ্ড পাওয়া সাংবাদিকের নাম শফিউজ্জামান রানা। তিনি জাতীয় দৈনিক দেশ রূপান্তরের শেরপুর জেলার নকলা উপজেলা সংবাদদাতা। গত ৫ মার্চ নকলা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ে তথ্য চেয়ে আবেদনের পর সরকারি নিয়ম মেনে তাকে তথ্য না দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে এ দণ্ড দেওয়া হয়।

সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানার বিরুদ্ধে অভিযোগ 'সরকারি কাজে বাধা, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি ও অসদাচরণ'। অথচ তিনি কয়েকটি প্রকল্পের ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ের তথ্য চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে ইউএনও কার্যালয়ে আবেদন করেন। এসব প্রকল্পের তথ্য চাওয়ায় তার ওপর ক্ষুব্ধ হন নকলার ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন। এরপর থানা পুলিশ এনে শফিউজ্জামান রানাকে আটক করে তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দণ্ড দেওয়া হয়। দণ্ড দেওয়া কর্মকর্তা নকলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী হাকিম মো. শিহাবুল আরিফ। ছয় মাসের দণ্ড পাওয়া সাংবাদিক রানা এখন শেরপুরের কারাগারে বন্দি।

সরকারি ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যাচ্ছে, নকলার ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন ৩৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে ওই উপজেলায় যোগ দিয়েছেন গত বছরের ৫ জুন, এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শিহাবুল আরিফ ৩৭তম বিসিএস উত্তীর্ণ এবং ওই উপজেলার কর্মস্থলে যোগ দেন ২০২২ সালের ৭ জুলাই। মাঠপ্রশাসনের এই দুই কর্মকর্তা যা করেছেন সেটা একদিকে যেমন স্বাধীন সাংবাদিকতার হুমকি, অন্যদিকে এটা ক্ষমতার অপব্যবহার।

সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানার সহকর্মী ও তার পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম জানাচ্ছে, শফিউজ্জামান রানা এডিপি প্রকল্পের কম্পিউটার ও ল্যাপটপ ক্রয়–সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে ইউএনও কার্যালয়ে আবেদন জমা দেন। এরপর তিনি 'আবেদন গ্রহণের অনুলিপি' ইউএনও কার্যালয়ের কর্মচারী গোপনীয় সহকারী (সিএ) শীলার চাইলে তাকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। সে অনুযায়ী তিনি অপেক্ষা করেন এবং এক পর্যায়ে ফের তাগাদা দেন অনুলিপির জন্যে। তখন শীলা ইউএনওকে ছাড়া সেটা দিতে অস্বীকৃতি জানান। সাংবাদিক রানা বিষয়টি জেলা প্রশাসককে বিষয়টি জানালে ইউএনও তার ওপর ক্ষুব্ধ হন। একপর্যায়ে নকলা থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ইউএনও এবং সিএ শীলার সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগে শফিউজ্জামানকে আটক করে। পরে নকলা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শিহাবুল আরিফ ওই কার্যালয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে শফিউজ্জামান রানাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়।

তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এই অভিযোগকে অস্বীকার করে সহকারী কমিশনার (ভূমি) শিহাবুল আরিফ দাবি করেছেন, 'সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানাকে সরকারি অফিসে অনুপ্রবেশ করে হট্টগোল, সরকারি কাজে বাধা, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি ও অসদাচরণের অভিযোগে দণ্ডবিধির ১৮৬০–এর ১৮৮ ধারায় এবং একজন নারী কর্মচারীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।' অভিন্ন সুর ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিনেরও। তার দাবি, ‘সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানা তথ্য চেয়ে আবেদন করতে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি তখনই তথ্য চান। আমি তাকে বলি, এখন আমার মিটিং আছে। তথ্য দেওয়ার জন্য আমার হাতে ২০ দিন সময় আছে। কিন্তু তিনি সিএ শীলার কাছে থাকা ওই তথ্যের ফাইল টানাটানি করেন এবং নানা ধরনের অশালীন ভাষায় কথাবার্তা বলেন। তিনি অসদাচরণ করেছেন। এতে অফিসের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। তাই আমি সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে বলেছি।'

ইউএনও ও সহকারী কমিশনারের যে বক্তব্য সেটা কোনো বিচারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোন সাংবাদিক সরকারি দপ্তরের কোথাও গিয়ে ফাইল নিয়ে টানাটানি করবেন, সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে অশালীন ভাষায় কথা বলবেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। হ্যাঁ, তিনি তথ্যের আবেদন গ্রহণের অনুলিপি নিয়ে তাগাদা দিতে পারেন, কিন্তু এটা কোনোভাবে উত্ত্যক্তের পর্যায়ে পড়ে না, বরং সেটা তার পেশাদারত্ব। এছাড়া সাধারণ একটা আবেদনের রিসিভড কপি দিতে ইউএনও লাগবে কেন? এইধরনের কাজ ইউএনওদের করার কথা নয়।

এই ঘটনায় প্রমাণ হয় ক্ষমতার দম্ভ ও অপব্যবহার। ইউএনও ও সহকারী কমিশনারের ক্ষমতা আছে তাই তথ্য প্রদানের রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা ও আইনকে উপেক্ষা করে তারা তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়েছেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন সাংবাদিককে। কেতাবে যাই থাকুক, ক্ষমতার দম্ভে নীতি-নৈতিকতা ও আইন যে কতখানি অসহায় নকলার সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানার ঘটনা আরও একবার প্রমাণ করছে।

শফিউজ্জামান রানা মফস্বলের সাংবাদিক। তাই অন্যায়ভাবে তাকে দেওয়া এই দণ্ডের নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়নি। তার কর্মক্ষেত্র দৈনিক দেশ রূপান্তর এরআগে সরকারি দপ্তরের দুনীতির বেশ কিছু প্রতিবেদন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছিল, তবে পত্রিকাটিকে পুরো সরকার-প্রশাসন-দেশকে-সুশীল সমাজকে নাড়া দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই বলে এই কারাদণ্ড জাতীয় ইস্যু হয়ে ওঠতে পারেনি। ফলে দুই 'পাবলিক সার্ভেন্টের' ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে সুশীল সমাজ, সরকার-প্রশাসনের কাছে পৌঁছেনি। দলাদলি, তোষণ, ব্যক্তিগত অর্জন আর সংসদ সদস্য হিসেবে 'নিযুক্ত' হওয়া লক্ষ্য যখন অনেকের, তখন গুরুতর এই অবিচার নিয়ে কড়া প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে।

কেন্দ্রে যখন ঋজু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রতিনিধির অভাব সেখানে মফস্বলেও একই অবস্থা। কেন্দ্রে তোষণ করে চলেন সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা, আর মফস্বলে অধিকাংশ। মফস্বল সাংবাদিকদের একাংশকে প্রায়ই দেখা যায়, সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি বিনত ভাব। প্রায়ই দেখা মেলে এমন সংবাদ বিজ্ঞপ্তি আর সামাজিক মাধ্যমের স্থিরচিত্র যেখানে ইউএনও, সহকারী কমিশনার, থানার ওসিদের ফুলের তোড়া দেওয়ার খবর। অনেকেই প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের কাছাকাছি থাকতে চায়। তোষণে ব্যস্ত থেকে পেশাদারত্ব ভুলে যায়। ফলে এরবাইরে থাকা কতিপয় সাহসী এবং পেশাদার সাংবাদিক বেকায়দায় পড়েন। ধারণা করি শফিউজ্জামান রানাও তেমন অবস্থায় পড়েছেন। ইউএনও-সহকারী কমিশনার এখানে অন্য অনেকের মতো তার কাছ থেকে তথ্যের আবেদন নয়, স্তুতি চেয়েছিলেন!

নকলার ইউএনও সাদিয়া উম্মুল বানিন ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. শিহাবুল আরিফ গর্হিত কাজ করেছেন। তারা ক্ষমতার দম্ভে যা করেছেন সেটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে বলে ধারণা করি। তাদের মতো কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে দেশে-বিদেশে সরকার ও দেশ ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে। তাদের মতো কিছু লোকের কারণে মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে যাচ্ছে।

প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের মে মাসে বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)-এর মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩তম বলে উল্লেখ হয়। বৈশ্বিক সংস্থাটির ২০২২ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬২তম, এরআগে ২০২১ সালে ছিল ১৫২তম এবং ২০২০ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫১তম। অর্থাৎ ক্রম-নিম্নমুখী বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক তৈরিতে আরএসএফ মূলত পাঁচটি বিষয় বিবেচনায় নেয়। সেগুলো হলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আইনি অবকাঠামো, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও নিরাপত্তা। নকলার সাংবাদিককে দণ্ড দেওয়ার ঘটনাটি গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে উল্লেখ করে।

লক্ষণীয় বিষয়, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর সূচক সরকারের মন্ত্রীদের বিব্রত করেছে, তারা এর প্রতিবাদও করেছেন। নতুন সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলি আরাফাত গত মাসের ১৯ তারিখে সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)-এর প্রতিবেদন ও র‍্যাঙ্কিং নিয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, 'বাংলাদেশে সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)-এর ওয়েবসাইটে যে প্রতিবেদন ও র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ হয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা আছে।' প্রতিমন্ত্রীর দাবি, 'ওয়েবসাইটে ভুল, অর্ধসত্য ও অপর্যাপ্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ১৬৩তম দেখানো হয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ক্রমবিকাশ, সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণ এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার জন্য বর্তমান সরকারের অব্যাহত উদ্যোগকে অস্বীকার করা হয়েছে।' প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের সূত্র ধরে এখানে আমরা বলতে পারি, ভুল তথ্য থাকতে পারে আরএসএফ-এর প্রতিবেদনে, কিন্তু এটা পুরোপুরি অসত্য নয়। নকলার সাম্প্রতিক এই ঘটনা কি প্রমাণ করে না কর্মক্ষেত্র কতখানি প্রতিকূল সাংবাদিকদের?

নকলার সাংবাদিককে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষমতার অপব্যবহারের পাশাপাশি এটা স্বাধীন গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ভয়াবহ হুমকি। ঘটনার পূর্বাপর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নকলার ঘটনা 'ফরমায়েশি'। সাংবাদিক শফিউজ্জামান রানার তথ্য প্রাপ্তির আবেদন এবং ডিসির কাছে মোবাইল ফোনে প্রতিকার চাওয়ার ইউএনও পছন্দ করেননি, তাই তিনি থানার পুলিশকে ডেকে এনে প্রথমে আটক করেছেন, এবং সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ডেকে এনে কারাদণ্ড দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ ইউএনও চেয়েছেন বলে তার অধীনে থাকা সহকারী কমিশনার সাংবাদিককে কারাদণ্ড দিয়েছেন!

ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোড়ন না তুললেও তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করার পরও সাংবাদিককে তথ্য না দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়ার বিষয়টি অনুসন্ধানের নির্দেশ দিয়েছে তথ্য কমিশন। বৃহস্পতিবার কমিশনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, তথ্য কমিশনার শহীদুল আলমকে আইন অনুযায়ী অনুসন্ধান কার্যক্রম সম্পন্ন করে প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করতে বলা হয়েছে। আমরা আশা করতে চাই সঠিক প্রতিবেদনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার দম্ভ ও অপব্যবহারের প্রতিবিধানের। তা না হলে প্রথা-প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাবে, মুখ থুবড়ে পড়বে অবাধ তথ্যপ্রবাহের বহুল-উচ্চারিত স্লোগান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর