‘এমন ভয়াবহ আগুন আমি কখনোই দেখিনি। দাউদাউ করে জ্বলছে পুরো মাঠ। মাঠের পর মাঠ পানবরজে আগুনের লেলিহান দাবালনের মতো কয়েকটি গ্রামের পানবরজ পুড়ে ছারখার করে দিলো। আমারও এক বিঘা জমির পানবরজ পুড়ে ছারখার হয়ে গেলো’-ভয়াবহ এ দৃশ্যের সাক্ষী ষাটোর্ধ আবদুল লতিফ মিয়া সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
আবদুল লতিফ মিয়া কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের গোসাইপাড়া এলাকার বাসিন্দা। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তার এক বিঘা জমির পানবরজ পুড়ে গেছে।
তিনি বলেন, মাঝে মাঝেই পানবরজে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। তবে এবার কয়েকটি গ্রামের হাজার বিঘা পানবরজ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
রবিবার (১০ মার্চ) দুপুরের দিকে উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়টা গ্রামের জিআরপি ক্যাম্পের নিচে মিলন আলির পানের বরজ থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে।
আগুনের লেলিহান শিখা আশপাশের কমবেশি ৫-৭ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে রায়টা, আড়কান্দি, মাধবপুর, গোসাইপাড়া, মালিপাড়া, মেঘনাপাড়ার ছয়টি গ্রামের পানবরজে আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আগুন আতঙ্কে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে।
পানবরজগুলো খুব কাছাকাছি হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের তীব্রতা এতই বেশি যে ১ কিলোমিটার দূরে ও বাতাসে ছাই উড়ে গিয়ে আগুন ধরতে থাকে। প্রবল বাতাসে মুহূর্তেই এই আগুন আশপাশের পানবরজে ছড়িয়ে পড়ে।
পরে ভেড়ামারা ছাড়াও জেলার মিরপুর, কুমারখালি, কুষ্টিয়া সদর, পাবনার ঈশ্বরদী, মেহেরপুর, নাটোরের লালপুর ও চুয়াডাঙ্গাসহ ফায়ার সার্ভিসের ১২টি দল টানা ৬ ঘণ্টা ধরে চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, আগুনে প্রায় ৪ কিলোমিটার পানের বরজ পুড়ে গেছে। প্রথমে কোনোভাবেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছিল না। আগুনের লেলিহান শিখা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ সময় বেশ কয়েকটি বাড়িতেও আগুন লাগে। আশপাশের এলাকা থেকে লেপ, কাঁথা, কম্বল, খাদ্যশস্য, গবাদি পশুর সরিয়ে নেওয়া হয়। গ্রামের লোকজন অসহায়-সম্বল রক্ষায় চারিদিকে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়।
আগুন লাগার পরপরই পাশের পানবরজগুলো মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আগুনের লেলিহান শিখা দাউদাউ করে জ্বলে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। হাজারো মানুষের স্বপ্ন মলিন করে দিয়েছে।
বাহাদুরপুর ইউপি চেয়ারম্যান সোহেল রানা পবন সাংবাদিকদের বলেন, ‘রবিবার দুপুর রায়টা পাথর ঘাট এলাকার মাঠে আকস্মিকভাবে একের পর এক পানবরজে আগুন লাগতে শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে হতভম্ব হয়ে পড়ি। এমন আগুন লাগা আমার বয়সে দেখিনি। মুহূর্তের মধ্যে বাহাদুরপুরের ৬-৭টা গ্রামের পানবরজে ছড়িয়ে পড়ে আগুন।’
প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্ষতিগ্রস্ত পান চাষী ওহায়েদ মেম্বর, সাফিকুল ও আরজ আলী জানান, পানবরজে হঠাৎ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটে। প্রবল বাতাসে মুহূর্তেই এই আগুন আশপাশের অন্যান্য পানবরজে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা হচ্ছে, একশ বিঘা জমির প্রায় দেড় কোটি পিলি পানের বরজ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
পান চাষী শামীম হোসেন বলেন, ‘আমার দুই বিঘা পান ছিল। সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমার ৫ থেকে ৬ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই পানবরজ আমার পরিবারের আয়ের একটা উৎস ছিল। কিন্তু পুড়ে গিয়ে আমি একবারেই নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’
পান চাষী তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘রায়টা পাথরঘাট এলাকা থেকে অগ্নিকাণ্ড শুরু হয়। তারপর আড়কান্দী ও মাধবপুর গ্রামের মাঠের পানের বরজ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রতি বিঘায় কমপক্ষে তিন লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। আমার দুই বিঘা পান ছিল। দুই বিঘায় প্রায় ছয় লাখ টাকার পান হতো। পুরোটাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’
কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এএইচ এম আবদুর রকিব ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
চুয়াডাঙ্গার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক রফিকুজ্জামান বলেন, ‘পান বরজে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট কাজ শুরু করি। এলাকাবাসী সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, আগুনে প্রায় ৪ হাজার বিঘার পান বরজ পুড়ে গেছে। প্রাথমিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আমরা নিরূপণ করতে পারিনি।’
কুষ্টিয়া-২(মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনের সংসদ সদস্য কামারুল আরেফিন বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটির ওপর। এটা এই অঞ্চলের কৃষকদের জন্য এক মহাবিপর্যয়। সরকার অবশ্যই কৃষকদের পাশে দাঁড়াবে। কেউ অন্যায়ভাবে আগুন লাগালে আল্লাহ তার বিচার করবে।’