‘বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’- লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই লেখনিতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে সমাজে যার অবস্থান যেখানে তাকে সেখানেই মানায়।
তবে সময়ের সাথে বদলেছে সে পরিধি। কালের গতিতে ভালোবাসার পরিধিও বেড়েছে। ভালোবাসার বন্ধন এখন ছড়িয়ে পড়েছে মনুষ্য থেকে পশুপাখিতে। তবে শুধু ভালোবাসাতেই নয়। পশু-পাখির সেবাই করাই কারও কারও জীবনের লক্ষ্য। তাদের মধ্যে একজন লালমনিরহাটের যুবক আব্দুর কাইউম প্রিন্স। পশু সেবা করাই যার ব্রত। সে ব্রতই তার জীবনে এনেছে প্রশান্তি। পশু সেবা করেই পার করতে চান বাকিটা জীবন।
জীবনের সফল হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে পড়াশুনার তাগিদে উত্তরের জেলা লালমনিরহাট থেকে ২০০৮ সালে ইট পাথরের শহর ঢাকায় পা রাখেন প্রিন্স। কলেজে জীবনে বন্ধুর কুকুর-বিড়ালের সেবা দেখে নিজেও জড়িয়ে পড়েন সে কাজে । ভালো লাগার কাজ এখন পরিণত হয়েছে নেশাতে। ২০১৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় চার হাজার অসুস্থ কুকুরের চিকিৎসা করেছেন তিনি। নিজের বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন পশু পাখির অভয়াশ্রম। সময়ের সাথে ভালোবাসা কুড়িয়েছেন পশু পাখির।
কোথাও কোন অসুস্থ কুকুর দেখলেই দ্বিধা ছাড়াই কোলে তুলে নেন কাইউম। সন্তানের মতো পরম যত্নে সেবা করেন তিনি। পশুর প্রতি ভালোবাসার কারণে চাকরির সুযোগ পেয়েও করেননি তিনি। এতে প্রিয়জন ছেড়ে গেছেন কাইউমের। শুধু প্রিয়জন নয়, কুকুর বিড়ালের সেবা করায় আত্মীয় স্বজনরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তার থেকে। তবুও হাল ছাড়েন নি কাইউম। বন্ধুরাও তার সাথে না মেশায় ঘরে মা-বাবা আর বাইরে পশুপাখিকেই এখন আপনজন ভাবেন প্রিন্স।
এদিকে চিকিৎসা করতে গিয়ে একাধিকবার কুকুরের কামড় খেয়েছে প্রিন্স। তবে সে কামড়ের যন্ত্রণার থেকে কোটি গুণ বেশি যন্ত্রণা পেয়েছেন সমাজের মানুষের ধিক্কার থেকে। সেই গল্পই বার্তা২৪.কমকে বলেছেন আব্দুল কাইউম প্রিন্স।
তিনি বলেন, ছোট বেলায় বাবাকে দেখতাম কুকুর বিড়ালকে খাওয়াতেন। সেটা আমার ভালো লাগত। আমিও সুযোগ পেলে খাওয়াতাম। চেষ্টা করতাম তাদের খেয়াল রাখার। আমি যখন পড়াশুনার জন্য ঢাকায় আসি ,তখন আমার বন্ধুকে দেখতাম সে কুকুর বিড়ালের চিকিৎসা করত। বিষয়টি আমার ভালো লাগত। আর সেই ভালো লাগাটাই আজ আমাকে এখানে এনেছে। তার সাথে কিছুদিন আমি কাজ করে সব শেখার পর একাই কাজ শুরু করি। করোনা কালে আমার অনেক বেশি কাজ করা হয়েছে কুকুরদের নিয়ে। ভালো লাগার কাজটা কখন যে আমার নেশায় পরিণত হয়েছে তা বুঝতেই পারেনি। এখন একদিন কুকুরের চিকিৎসা না করলে আমার ওই দিনটাই খারাপ কাটে।
আগে আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করতাম। তাতে অনেক বেশি খরচ হতো । কিন্তু আমার বেকার মানুষের পক্ষে তা সম্ভব হত না। তাই পরে কোন অসুস্থ কুকুরের খোঁজ পেলে তার অবস্থা দেখে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করি। একটি কুকুরের পিছনে কখনো পাঁচদিন কখনো এক মাসেও লেগে যায়। আমি সকাল ১০টায় কাজ শুরু করি রাত ৩টা পর্যন্ত কাজ করি।
তিনি বলেন, কুকুরের সেবা করি বলে আমার সাথে আমার বন্ধুরা খারাপ ব্যবহার করে। তারা বলে আমি নাকি পাগল। আমার মাথার সমস্যা আছে। কেউ কেউ তো আমাকে নাস্তিকও বলে। বাড়িতে কুকুর বিড়ালে আছে বলে আমার আত্মীয়-স্বজন কেউ আমার বাড়িতে আসে না। আসলেও কেউ ভাত খায় না। সবাই ঘৃণা করে। শেষে আমার ভালোবাসার মানুষও আমাকে ছেড়ে গেছে। এখন আমার আপন বলতে আমার মা-বাবা আর এই পশুপাখিরা।
কাইউম বলেন, সমাজের মানুষ বেঈমানি করলেও পশু পাখিরা কখনো বেঈমানি করে না। মানুষ তো সৃষ্টির সেরা জীব। পশুপাখি তাদের থেকে সহানুভূতি পাবে এটাই নিয়ম । তবে মানুষ সব থেকে বেশি নির্যাতন করে পশুপাখিকে। তবে আঘাত না করে চাইলেই পাঁচ টাকা কিংবা ১০ টাকা দিয়ে খাবার কিনে দিতে পারে । কিন্তু তা না করে আঘাত করে। আর আঘাতের জন্য কুকুর রা বেশি হিংস্র হয়ে উঠে।
পশুর প্রেমে সব হারিয়ে পৃথিবীতে আর কোন চাওয়া পাওয়া নেই কাইউমের। ইচ্ছা জীবনের শেষ সময়েও হলেও পশু পাখিদের জন্য তৈরি করবেন একটি নিরাপদ স্থান। যেখানে ফ্রিতে মিলবে পশু পাখির চিকিৎসা ও নিরাপদ জীবন ।