‘দুঃখিত বিছানা খালি নাই’ বলেই দায় শেষ!

, জাতীয়

মো: রাকিব হাসান ও রুহুল আমিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2024-03-25 09:57:23

আনোয়ারা বেগম নামাজের শেষ প্রান্তে এসে জায়নামাজে বসেই হঠাৎ নির্বাক; প্রায়-নিশ্চল শরীর নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। তার পাশে থাকা ছেলের বউ বারবার কী হয়েছে জানতে চাইলেও উত্তর দেয়ার মতো শারীরিক অবস্থায় ছিলেন না তিনি। অতীত অভিজ্ঞতা থাকায় ছেলের বউয়ের বুঝতে বাকি থাকল না যে, তার শাশুড়ি ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন। সাথে সাথে পরিবারের অন্য সদস্যদের জানালে দ্রুত তারা আগারগাঁও ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্সস অ্যান্ড হাসপাতালের (এনআইএনএস) জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন।

দ্রুত টিকিট কেটে কর্তব্যরত চিকিৎসকের নিকট নিয়ে গেলে প্রাথমিক পরীক্ষানিরীক্ষা শেষে সিটি স্ক্যান করে চিকিৎসক নিশ্চিত হন মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। কর্তব্যরত চিকিৎসক ভর্তির পরামর্শ দিলেও ব্যবস্থাপত্রে নীল কালিযুক্ত সিলে বড় করে লিখে দিলেন—‘দুঃখিত বিছানা খালি নাই’; দায় যেন শেষ! আর এভাবেই প্রতিদিন এই হাসপাতাল অসংখ্য রোগীর কপালে জোটে একই ভাগ্য।

২৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আদলে নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অপারেশন ও চিকিৎসা সেবা চালুর কথা থাকলেও মাত্র এক যুগ পার হতে না হতেই বেড সংকটে ভুগছে হাসপাতালটি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে আগারগাঁওয়ে ২০০৩ সালে ১০ তলা ভবনে ৩০০ বেডের একটি পূর্ণাঙ্গ নিউরোসায়েন্স ইন্সটিটিউট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। তারপর ২০০৯ সালে নিউরোলজি ও নিউরো সার্জারি বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসাসেবা দেশে প্রতিষ্ঠা করার কার্যক্রম শুরু করা হয়। তারপর ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে চালু হয় জাতীয় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালটি।

শুরু থেকেই প্রত্যাশার পারদ ছিল ওপরের দিকে, ধীরে-ধীরে সারাদেশে সুনামও কুড়ায় হাসপাতালটি। তবে বেড-সীমাবদ্ধতা আর ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে হিমশিম খেতে হয় হাসপাতালটিকে। বাড়ছে রোগীর সংখ্যা তবে সে তুলনায় বাড়েনি ডাক্তার বা বেডের সংখ্যা। তাই বেড খালি না থাকার কারণে হতাশ হয়ে ফিরতে হয় রোগীদের। কঠোর নজরদারির মধ্যেও অভিযোগ আছে ওয়ার্ড বয় থেকে শুরু করে হুইল চেয়ারবয়দের কর্তৃক রোগীদের কাছে টাকা চাওয়ার বিষয়ে।

সরেজমিনে হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে বার্তা২৪.কম প্রতিবেদককে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা জানান, ওয়ার্ড বয় থেকে শুরু করে হুইল চেয়ারবয়দের অনেকেই ১০০-২০০ টাকা দাবি করেন। তবে কীসের টাকা জানতে চাইলে তারা কোন সদুত্তর দেন না। অভিযোগ রয়েছে, ওয়ার্ড বয় আর নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকা আনসার সদস্যদের ব্যবহার নিয়েও। এছাড়াও বেড স্বল্পতার সমস্যায় পড়তে হয় দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীদের। অচেনা-অজানা জায়গায় রোগী নিয়ে এসে বেড না পেয়ে অনেকে পড়েন দালালদের খপ্পরে। টাকা খরচ করে চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসার শিকার হন রোগী।

তেমনই এক ভুক্তভোগী আবুল কালাম আজাদ। ব্রেইন স্ট্রোকের রোগী মাকে নিয়ে চিকিৎসা করাতে এসেছেন মিরপুর থেকে। অনেকটাই হতাশা ও ক্ষোভ জানিয়ে বার্তা২৪.কমকে বলেন, মা ব্রেইন স্ট্রোক করেছেন, তাই দ্রুত নিউরোসায়েন্স ইন্সটিটিউট হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। কিন্তু আসার পরে থেকে হাসপাতালের দারোয়ান থেকে ডাক্তার সবার ঝাড়ির ওপর আছি। সেবা নিতে আসছি, নাকি আমরা তাদের বাড়ির চাকর বুঝতে পারছি না। কিন্তু টাকা দিলে আবার সব ঠিক।

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে হাসপাতালটিতে অবস্থান নিয়ে দেখা যায়, অনেকটাই সুষ্ঠু পরিবেশে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন ডাক্তারসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সিরিয়াল দিয়ে টিকিট কেটে আউটডোরের নির্দিষ্ট চিকিৎসকের কাছ থেকে সেবা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা। এদিন ইমার্জেন্সিতেও দেখা যায়নি তেমন ব্যস্ততা। তবে আউটডোরের ভিতরের অপ্রতুল বসার স্থান ও বাহিরের লবিতে কোন রকম বসার ব্যবস্থা না থাকায় রোগী ও স্বজনদের দাঁড়িয়ে থেকে সেবা নিতে হচ্ছে।

হাসপাতালটিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনরা চিকিৎসা সেবা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও কিছু কিছু কর্মচারীর ব্যবহারে অসন্তুষ্ট। সরেজমিনেও বেশ কয়েকবার এক আনসার সদস্যের সাথে রোগীর স্বজনদের বাগবিতণ্ডায় জড়াতে দেখা যায়।

ফরিদপুর থেকে অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে এসেছিলেন ষাটোর্ধ এক বৃদ্ধা। চিকিৎসকের পরামর্শে ভর্তি করিয়েছেন হাসপাতালে। হাতে থাকা কাপড়ের ব্যাগসহ বেডে উঠতে যাচ্ছিলেন বৃদ্ধা কিন্তু এখানেই বাঁধলো বিপত্তি। আনসার সদস্য কোনভাবেই তাকে ব্যাগ নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে দেবেন না। তারও প্রশ্ন, আমি ব্যাগ রাখব কোথায়? কাপড়-চোপড় নেব কীভাবে? এ-নিয়ে তর্কাতর্কি একসময় গড়ায় তুই-তোকারিতে। পরে বৃদ্ধার ভাগ্নে এসে আনসার সদস্যের এমন দুর্ব্যবহারের কারণ জানতে চাইলে তার সাথেও উত্তেজিত হয়ে পড়েন সেই আনসার সদস্য। উত্তেজনা রূপ নেয় হাতাহাতিতে। তবে আশেপাশের লোকজন ও অন্যান্য আনসার সদস্যরা এসে নিবৃত্ত করে দুই পক্ষকে।

আনসার সদস্যের রোগীর স্বজনের সাথে করা এমন দুর্ব্যবহার নিয়ে বার্তা২৪.কম প্রতিবেদক কথা বলে হাসপাতালটির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ও আনসার কমান্ডারের সাথে। হাসপাতালটির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ডা. মোস্তাফিজুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, রোগীরা এখানে আসেন সেবা নিতে। আমাদের দায়িত্ব রোগীদের সাথে সর্বোচ্চ ভালো ব্যবহার করা ও তাদের সেবা পেতে সহযোগিতা করা। যে ঘটনাটি ঘটেছে এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি এখনই নির্দেশনা দিচ্ছি যেন সে আনসার সদস্যকে এখনই অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়।

হাসপাতালের প্লাটুন কমান্ডার আতাউর রহমান বার্তা২৪.কমকে অভিযুক্ত আনসার সদস্যকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা নিশ্চিত করেন। পরে তিনি বলেন, স্যার আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। সে নির্দেশনা অনুযায়ী অতিদ্রুতই অভিযুক্ত আনসার সদস্যকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।

এ সম্পর্কিত আরও খবর