বোয়িংয়ের প্লেনে আয় নয়, দায় বাড়ছে বিমানের

ঢাকা, জাতীয়

ইশতিয়াক হুসাইন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 23:39:58

নতুন কেনা বোয়িং কোম্পানির উড়োজাহাজগুলো সঠিক ও উপযুক্ত রুটে ব্যবহার না করে সম্পদ ও অর্থের অপচয় করছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এসব উড়োজাহাজ দিয়ে এয়ারলাইন্সের আয় বাড়ার কথা ছিল। কিন্তু তা না হয়ে এতে দায় বাড়ছে বিমানের।

দূরপাল্লার রুটের অভাবেই বহরে থাকা বোয়িংগুলোর পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আর এতে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্স প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন নয়। ২০১১ সাল থেকে বিমানের বহরে প্রথম যুক্ত হয় বোয়িং ৭৭৭ ৩০০ ইআর উড়োজাহাজ। এরপর বিমানের বহরে একে একে যুক্ত হয়েছে দুটি বোয়িং ৭৩৭, দুটি ড্রিমলাইনার ৭৮৭সহ মোটি ৮টি ব্র্যান্ড নিউ উড়োজাহাজ।

বিমান ২০০৮ সালে মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং কোম্পানির সঙ্গে ১০টি নতুন উড়োজাহাজ কেনার জন্য ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি করে। এরইমধ্যে বহরে যুক্ত হয়েছে আটটি উড়োজাহাজ। বাকি দুটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার চলতি বছরের সেপ্টেম্বর।

বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ কেনা হয়েছিল স্বল্প দূরত্বে যাত্রী পরিবহনের জন্য। মূলত ঢাকা-ব্যাংকক, ঢাকা-সিঙ্গাপুর, ঢাকা-কুয়ালালামপুরের মতো আঞ্চলিক রুটে চলবে বোয়িং ৭৩৭। এই দুটি বাদে সবগুলো উড়োজাহাজই কেনা হয়েছিল দূরপাল্লার রুটে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য। বোয়িং ৭৭৭ ৩০০ ইআর ও ড্রিমলাইনার টানা ১৬ ঘণ্টার বেশি উড়তে সক্ষম। ঘণ্টায় ৬৫০ মাইল বেগে উড়তে সক্ষম ড্রিমলাইনারের উচ্চতা ৫৬ ফুট এবং এর পাখার আয়তন ১৯৭ ফুট।

বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞদের মতে, দূরপাল্লার রুটে চলা প্রতিটি উড়োজাহাজকে গড়ে ১২ ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করতে পারলেই এর যথাযথ ব্যবহার সম্ভব। কিন্তু বিমান একেকটি উড়োজাহাজকে গড়ে ৫ ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করতে পারছে না শুধুমাত্র সঠিক রুট প্ল্যানিংয়ের অভাবে।

বিমানের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেন, ২০১০ সালে বিমান যখন বোয়িংগুলো কেনার চুক্তি করে তখনই থেকে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ রুট প্ল্যানিং সম্পন্ন করা উচিত ছিল। অথচ দুই ঘণ্টা, তিন ঘণ্টার ফ্লাইটও পরিচালনা করা হচ্ছে এসব উড়োজাহাজ দিয়ে। এতে দামি এই বোয়িংগুলোর সাইকেল নষ্ট হচ্ছে। দুই ঘণ্টার ফ্লাইটেও যেমন একটি সাইকেল নষ্ট হবে, আবার ১২ কিংবা ১৬ ঘণ্টার ফ্লাইটেও একটি সাইকেল নষ্ট হবে। এভাবে ১৫০০ সাইকেল নষ্ট হলে উড়োজাহাজের বড় ধরনের রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয়। আর এতে প্রয়োজন হয় কয়েক কোটি টাকা।

বোয়িং ৭৭৭ ৩০০ ইআর এ আসন সংখ্যা ৪১৯ আর ড্রিমলাইনারে আসন ২৭১টি। অথচ এসব স্বল্প রুটের ফ্লাইটে পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় উড়োজাহাজসমূহের পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। গত ১১ জানুয়ারি ড্রিমলাইনার ব্যাংকক থেকে মাত্র ৫৬ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকায় অবতরণ করার উদাহরণও রয়েছে।  

অথচ ২০১১ সাল থেকে অত্যাধুনিক বোয়িং ৭৭৭ দিয়ে এবং পরবর্তীতে যুক্ত হওয়া ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার দিয়ে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুরের মতো স্বল্প দূরত্বের ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে।

এ নিয়ে বিমানের কর্মীদের মধ্যে যেমন ক্ষোভ রয়েছে তেমনি বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞরাও দূরপাল্লার উড়োজাহাজের স্বল্প দূরত্বে পরিচালনার বিরোধীতা করে আসছেন। বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্রথম থেকেই এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতার মুখে পড়লেও এখন পর্যন্ত আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি। যে কারণে এখনো স্বল্প দূরত্বের ফ্লাইটেই চলছে বোয়িং মডেলের উড়োজাহাজগুলো।

বিশেষজ্ঞরা মধ্য ও স্বল্প দূরত্বের রুটগুলোতে এসব উড়োজাহাজ না চালানোর পরামর্শ দেন তারা। বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিমানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কোনো রুট প্ল্যানিং না থাকায় যেখানে যে উড়োজাহাজ উপযুক্ত নয়, সেখানে তা দিয়ে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। এতে বিমানের সম্পদের যেমন অপচয় হচ্ছে, তেমনি আর্থিক ক্ষতিও হচ্ছে।  

এক সময় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ঢাকা-টোকিও, ঢাকা-নিউইয়র্ক,ঢাকা-প্যারিস, ঢাকা-ফ্রাঙ্কফুর্ট, ঢাকা-ম্যানচেস্টার, ঢাকা-রোমের মতো দূরপাল্লার ফ্লাইট পরিচালনা করতো। বিমান কর্তৃপক্ষ বলে আসছে এসব রুটে পুনরায় চালু করা হবে। আর এর মাধ্যমে এসব উড়োজাহাজের সঠিক ব্যবহার করবে বিমান।

এ প্রসঙ্গে বিমানের জেনারেল ম্যানেজার (পিআর) শাকিল মেরাজ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ড্রিমলাইনার নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন ও পরিকল্পনা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সের পৃথিবীটা আরো বড় হবে ড্রিমলাইনারের ওপর ভর করে। ঢাকা-দোহা-ঢাকা, ঢাকা-কুয়েত-ঢাকা, ঢাকা-মদিনা-ঢাকা রুটসমূহ পরিচালনা করা হবে ড্রিমলাইনার দিয়ে। অচিরেই বিমান ঢাকা-গুয়াংজু-ঢাকা, ঢাকা-কলম্বো-ঢাকা ও ঢাকা-মালে-ঢাকা রুটে পাখা মেলবে। নতুন রুটসমূহ ড্রিমলাইনার দিয়ে পরিচালনা করা হবে।’

‘তৃতীয় ও চতুর্থ ড্রিমলাইনার বহরে যোগ হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যাওয়া দিল্লী, হংকং, রোম, ম্যানচেস্টার, টোকিং ফ্লাইট পুনরায় চালু করার পাশাপাশি মন্ট্রিয়ল, সিডনির মতো দূরপাল্লার নতুন রুটেও পাখা মেলবে বিমান,’ বলেন শাকিল মেরাজ।   

তিনি বলেন, নিউইয়র্ক রুট চালুর ব্যাপারে বিমানের প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু বেবিচক যদি বাংলাদেশকে ক্যাটাগরি-১ উন্নীত করতে না পারে সেক্ষেত্রে তাদের কিছুই করার নেই।

এ সম্পর্কিত আরও খবর