১৫৯৯ একর জমির মালিক মল্লিকবাড়ি বন বিট নিজেই ভূমিহীন

ঢাকা, জাতীয়

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-30 23:31:49

ভালুকা (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে: ১৫৯৯ একর জমির মালিক হয়েও মল্লিকবাড়ি বন বিট এখন নিজেই ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। শুধু কি ভূমিহীন; যদি বাস্তহারা বলা যায় তাতেও ভুল হবে না। তার নিজের দাঁড়াবার জন্য সামান্য ঠাঁইও নেই।

অন্য বিটের আশ্রিত হিসেবে রয়েছেন খোদ বিট অফিসার। অথচ গেজেট অনুযায়ী মল্লিকবাড়ি বন বিটের জমির পরিমাণ ১৫৯৯ একর। সবটাই এখন ভূমিদস্যুদের গ্রাসে চলে গেছে। এক শতাংশ জমিও আর অবশিষ্ট নেই। বন বিভাগের সর্বোচ্চ কর্তারাও ২ বছর আগে সরেজমিন পরিদর্শন করেছিলেন। লক্ষ্য ছিলো একটু জায়গা উদ্ধার করে সেখানে অন্তত বিট অফিস স্থাপন করা। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সে উদ্যোগও থেমে যায়।

একজনতো টিপ্পনি কেটে বলেই বসলেন, এটি বিসিএস’এ প্রশ্ন হওয়ার মতো। কোন বিটের জমি নেই। মল্লিকবাড়িতে একজন বিট অফিসার রয়েছে, আবার তার অধীনে একজন বন প্রহরী ও ২ জন বাগানমালি রয়েছে। প্রশ্ন ছিলো কতোদিন আগে থেকে এই অবস্থা। এর সঠিক জবাব কেউই দিতে পারেন নি। কেউ বলেছেন ৪০ বছর, কেউ বলছেন ৫০ বছর, আবার কেউ কেউ ২০ বছরের কথা। এলাকার প্রভাবশালীরাই ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলেছে পুরো বিটের জমি। অথচ এরমধ্যে রিজার্ভ ফরেস্টও রয়েছে।

বন আইনে রিজার্ভ ফরেস্ট (সংরক্ষিত বন) সম্পর্কে বলা হয়েছে, এখানে সাধারণ জনগণের প্রবেশ করতে হলে বন বিভাগের পূর্বানুমতি নিতে হবে। কেউ যদি অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করে প্রয়োজনে গুলি ব্যবহার করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে বন বিভাগকে। অথচ সেখানে এখন বন বিভাগ প্রবেশ করার সাহস পায় না। বিট অফিস স্থাপনের জায়গা বের করতে গেলে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছে দখলবাজরা।

বিট অফিসার কুদরত-ই খুদা বার্তা২৪.কম কে বলেন, গেজেট অনুযায়ী মোট জমির পরিমাণ ১৫৯৯.০১ হলেও ২০ ধারা (রিজার্ভ ফরেস্ট) ভুক্ত রয়েছে ১৭টি দাগে ১৫৪.৮০ একর। ৫৩১ নম্বর দাগে রিজার্ভ ফরেস্ট রয়েছে ২১.৮০ একর। এখানে কাশেম সুপার নামের এক প্রভাবশালী প্রায় ৭ একরের মতো দখল করে রেখেছে।

বিট অফিসার বলেন, তিনি যোগদানের পর জমি উদ্ধারে ২৫টির মতো মামলা দিয়েছেন। তার আগের বিট অফিসারও প্রায় ৬টি মামলা দায়ের করে গেছেন। যেগুলো এখন বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারাধীন রয়েছে।

মল্লিকবাড়ি বন বিটটি ময়মনসিংহ বন বিভাগের ভালুকা রেঞ্জের আওতাধীন। ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের পাশে অবস্থিত হওয়ায় এখানকার জমি সোনার চেয়েও দাবী। এক শতাংশ জমির দাম ক্ষেত্র বিশেষে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। এখানে জমি জবরদখলে নামিদামী কোম্পানিও পিছুপা হয় নি। স্কয়ার, ওরিয়ন, এনভয়, বাদশা গ্রুপ, লভেলো আইসক্রিম, লাবিব ডাইং ও ব্র্যাকের মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান বনের জায়গা দখলে রেখেছে। বন বিভাগ মামলা দিয়ে নিজের দায় সেরেছে।

রাজনীতিতে অনেক মত পথ থাকলেও ভালুকায় বনের জমি দখলে আওয়ামী লীগ বিএনপি একাট্টা। কারো মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। বন বিভাগের জমি দখলে এখনও নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে বিএনপি নেতা শহীদুল ইসলাম শহীদ। বনের জমি বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে দখল করতে করতে তার নামই হয়ে গেছে বাউন্ডারি শহীদ। একসময় বনের নার্সারীতে (দৈনিক ৫ কেজি গমের বিনিময়ে) চারা লাগানোর কাজ করতেন। এখন নিজেই শত কোটি, মতান্তরে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তার নিজের দখলেই রয়েছে কয়েকশ একর জমি।

নিজে যেমন বনের জমি দখল করেছেন আবার বাইরে থেকে শিল্পপতিদের ডেকে এনে জমি দখল করে দিয়েছেন। জমি দখলের পদ্ধতিটা এখানে একটু ভিন্ন রকমের। প্রথমে ব্যক্তিমালিকানার কিছু জমি সংগ্রহ করেন। এরপর তার চারপাশে কয়েকশ বিঘা জমি বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে নেন। আর বাউন্ডারি স্থাপনে কোটি টাকার খেলার নেতৃত্ব দেন বাউন্ডারি শহীদ।  

তার রয়েছে কয়েকশ লাঠিয়াল বাহিনী। আর থানা পুলিশ যাতে কোনো বাধা হয়ে না দাঁড়ায় সে জন্য ব্যবহার করা হয় নগদ টাকা। আর এই টাকার গন্ধে বুদ হয়ে যায় পুলিশ প্রশাসন। সেই সুযোগে নির্বিঘ্নে জমি দখল করে নেয় দখলবাজরা। বন বিভাগের লোকজনও অনেক সময় নগদ টাকার গন্ধে চোখ বুজে থেকেছেন। আবার কখনও কখনও দায়সারা গোছের মামলা দিয়ে নিজের দায় সেরেছে।

শুধু কি মল্লিকবাড়ি বন বিট। অন্যান্য বিটের অবস্থাও যায় যায়। যেদিকে নজর যায় শুধু দখলবাজদের দৌরাত্ব্য। ঢাকা ময়মনসিংহ রোডের সিডস্টোর বাজারের জায়গাটি রিজার্ভ ফরেস্টের। যেখানে হরেক রকমের বন থাকার কথা, সে সব জায়গায় শোভা পাচ্ছে সারিসারি অট্টালিকা। প্রতিনিয়ত বেহাত হয়ে যাচ্ছে বনের জায়গা।

ময়মনসিংহ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা একেএম রুহুল আমিন বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমি সম্প্রতি এখানে যোগদান করেছি। আগে কি হয়েছে বলতে পারবো না। তবে আমরা মল্লিকবাড়ি বিটে মাথা ঢোকানোর চেষ্টা করছি। খুব শিগগিরই আমরা একটু হলেও দখলমুক্ত করে বাগান করা হবে।

কেন্দ্রীয় বন অঞ্চলের বন সংরক্ষক রকিবুল হাসান মুকুল বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, সারাদেশে বনের জমি ডিমার্কেশন করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এখানে বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকলে থাকবে। মার্ক করার কাজ শেষ হলে উদ্ধারে বিশেষ অভিযান করা হবে।

পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল্লাহ আল মহসিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিলো না। আমরা শিগগিরই তদন্ত টিম পাঠাবো। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর