নিরাপদ ট্রেনের অনিরাপদ যাত্রা

, জাতীয়

মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-04-17 21:59:48

বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ যানবাহন হিসেবে ধরা হয় ট্রেনকে। বিশালদেহী এ বাহন একসাথে হাজারো যাত্রী নিয়ে ছুটে চলে। তাছাড়া অন্য যানবাহনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভাড়া কম হওয়ায় সব শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে এ জনপ্রিয়তাও ব্যাপক।

বাংলাদেশে প্রথম রেলপথ ১৮৬২ সালে ব্রিটিশদের দ্বারা স্থাপিত হয়। তখন বাংলাদেশের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। একই বছরের ১৫ নভেম্বরে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বসূরি ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে দর্শনা রেলওয়ে স্টেশন থেকে জগতি রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত প্রসারিত প্রথম রেলপথ চালু করে।

নিরাপদ ও ইকোনমিক হওয়ায় ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বেড়েছে রেললাইনের দৈর্ঘ্য। নতুন নতুন জেলা ও উপজেলা রেলের নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। অনেক স্থানে সিঙ্গেল লাইন থেকে ডাবল লাইন হয়েছে।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এখনও জনগণের প্রধান বাহন রেলওয়ে। সেখানে বাংলাদেশে রেলওয়ের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনার অভাব আর বছরের পর বছর লোকসানের কারণে বারবার এর উন্নয়ন থমকে গেছে। সম্প্রতি রেলের উন্নয়ন কিছুটা চোখে পড়লেও এর নিরাপত্তার বিষয়টি এখনও অবহেলিত রয়ে গেছে।

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় রেল দুর্ঘটনা ঘটে ১৯৮৯ সালের ১৫ জানুয়ারি। টঙ্গীর কাছে মাজুখানে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১৭০ জন যাত্রী নিহত হন। আহত হন আরও ৪০০ জন। একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কাছাকাছি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে ১৩ জন নিহত হন ও ২০০ জন আহত হন।

এছাড়া ১৯৮৩ সালের ২২ মার্চ ঈশ্বরদীর কাছে সেতু পার হওয়ার সময় কয়েকটি স্প্যান ভেঙে ৬০ জন, ১৯৮৫ সালের ১৩ জানুয়ারি খুলনা থেকে পার্বতীপুরগামী সীমান্ত এক্সপ্রেসের কোচে অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জন, ১৯৮৬ সালের ১৫ মার্চ সর্বহারা পার্টির নাশকতায় ভেড়ামারার কাছে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে নদীতে পড়ে ২৫ জন, ১৯৯৫ সালের ১৩ জানুয়ারি হিলি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা গোয়ালন্দ থেকে পার্বতীপুরগামী লোকাল ট্রেনকে ধাক্কা দেয় সৈয়দপুর থেকে খুলনাগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস। মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই ট্রেনের ৫০ জনের বেশি যাত্রী প্রাণ হারান। এভাবে ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রতি বছরই নিরীহ যাত্রীরা প্রাণ হারাচ্ছেন।

২০২৩ সালের ৫ আগস্ট রেল পরিবহন ব্যবস্থা ও দুর্ঘটনার ওপর পর্যবেক্ষণ চালিয়ে এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে দুর্ঘটনার নয়টি কারণ চিহ্নিত করেছে শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম (এসসিআরএফ)।

কারণগুলো হলো:

কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, সিগনালিং ব্যবস্থায় ত্রুটি, ঝুঁকিপূর্ণ রেলক্রসিং, ইঞ্জিনের সক্ষমতার অতিরিক্ত বগি সংযোজন, রেললাইনে পাথরের স্বল্পতা, ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতু, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, জনবল সংকট এবং নড়বড়ে ট্র্যাক তথা রেললাইনে নিম্নমানের স্লিপার ও ফিশপ্লেটসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার।

সম্প্রতি এর সাথে নতুন করে দুটি কারণ যুক্ত হয়েছে। গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়া ও ইকোলাইজার বিম ভেঙ্গে ট্রেন দুর্ঘটনা।

চলতি বছরের ৪ মার্চ সিলেট-ঢাকা রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার আজমপুর স্টেশনের কাছেই অন্তত ১৫ ফুট রেললাইন বেঁকে যেতে দেখা গেছে। মার্চ মাসের অপেক্ষাকৃত কম গরমেই যদি রেললাইন বেঁকে যায়, তবে এপ্রিল মে মাসের প্রচণ্ড গরমে ট্রেন যাত্রা কতোটা নিরাপদ হবে তা বিবেচনার বিষয়।

বুধবার (১৭ এপ্রিল) জামালপুরের তারাকান্দি থেকে ছেড়ে আসা ঢাকা অভিমুখী যমুনা এক্সপ্রেসের ট্রেনটির ইকোলাইজার বিম ভেঙে যাওয়ার কারণে লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন রেল সংশ্লিষ্ট উদ্ধার কর্মীরা। এটা যদি সঠিক হয় এর রক্ষণাবেক্ষণের সাথে জড়িতদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। নতুবা এক্ষেত্রে তাদের চরম উদাসীনতা লক্ষণীয়।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপদাহ, যা অব্যাহত থাকতে পারে আরও কয়েকদিন। ফলে সবচেয়ে নিরাপদ যান হিসেবে পরিচিত ট্রেনে বাড়ছে ঝুঁকি। অতিরিক্ত তাপে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার কারণে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।

আখাউড়া সেকশনের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান তারেক বলেন, রেললাইনে ৪৫ থেকে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সহনশীল। কোনোভাবে যদি রেললাইনের তাপমাত্রা ৪৮ থেকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে যাত্রীবাহী ট্রেনকে সর্বোচ্চ ৪০ এবং মালবাহী ট্রেনকে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটার গতিতে চলতে হবে। অন্যথায় অতিরিক্ত গরমে রেললাইন কোথাও বেঁকে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে রেললাইনের তাপমাত্রা নিয়মিত মনিটরিং ও এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে যে কোনো সময় আরও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর