শত শত কোটি টাকার প্রকল্পেও বদলায়নি ট্রাফিক ব্যবস্থা

, জাতীয়

রাজু আহম্মেদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম | 2024-04-23 18:23:15

নেত্রকোনা জেলার মো. ফেরদৌস হোসেন। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বাংলাদেশ পুলিশে। চাকরি জীবনের ২২ বছরের প্রায় ১০ বছরেই দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাফিক বিভাগে। বিশ্বের ছোট-বড় বেশিরভাগ দেশেই ট্রাফিক ব্যবস্থায় রিমোট কন্ট্রোল লাইট অথবা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হলেও বাংলাদেশে এখনো ভরসা ফেরদৌস হোসেনদের হাতের ইশারা।

ফলে প্রতিনিয়ত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি নিয়েই গাড়ির সামনে দাঁড়াতে হয় ফেরদৌস হোসেনের মতো এ-বিভাগের দায়িত্বরত সবাইকে। কখনো কখনো হাতের ইশারার এই ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে হতে হয় দুর্ঘটনার শিকার। রোদ অথবা বৃষ্টি যাই হোক। ডিজিটাল বাংলাদেশে এখনো দায়িত্ব পালনে দু-পায়ের উপর ভর দিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকাই বড় দায়িত্ব ফেরদৌস হোসেনের।

ফেরদৌস হোসেন বলেন, রোদ হোক বৃষ্টি হোক সরকারি কাজের জন্য আমাদের ঝুঁকি নিতে হয়। কখনো কখনো দুর্ঘটনার শিকারও হতে হয়। তবে আধুনিক ব্যবস্থা থাকলে আমাদের কষ্ট কম হতো। সাথে জীবনের ঝুঁকিও কমতো।


শুধু ফেরদৌস হোসেনই নন। যানজটের শহর ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে এমন করুণ গল্প প্রায় সাড়ে চার হাজার পুলিশ সদস্যের। এতে জনসম্পদ অপচয়ের পাশাপাশি বিপুল অর্থও ব্যয় হচ্ছে সরকারের।

জনসম্পদ অপচয়ের পাশাপাশি ভোগান্তি পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষও। হাতের ইশারায় নিয়ন্ত্রণের ফলে অতিরিক্ত সময় রাস্তায় বসে থাকতে হচ্ছে অনেককে। পাশাপাশি পথচারীদের ঝুঁকিও ক্রমশ বাড়ছে ঢাকার সড়ককে।

প্রাইভেট কারচালক সামসুল হক বলেন, চলন্ত অবস্থায় দায়িত্বরত পুলিশদের দেখা যায় না। তাদের হাতের ইশারা কখনো কখনো চোখে পড়ে না । এর জন্য আমাদের জরিমানা গুনতে হয়। এছাড়া যখন তখন মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে। এতে দুর্ঘটনাও ঘটছে। আধুনিক ব্যবস্থা থাকলে এসব এড়ানো যেত।

তথ্য অনুসারে, ২০০১-০২ অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের (ডিইউটিপি) আওতায় ৭০টি ইন্টারসেকশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন করা হয়। এছাড়া ২০১২-২৩ অর্থবছরে ‘ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ (কেস) প্রকল্পের আওতায় আবারও ২৯টি ইন্টারসেকশনে ডিজিটাল ট্রাফিক সিস্টেম ব্যবস্থা বসানো হয়। এই প্রকল্পেও ছিল বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা। এসব প্রকল্পেরে দেখভালের দায়িত্ব ছিল দুই সিটি করপোরেশনের। তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব প্রকল্প দেখেনি আলোর মুখ। অল্প কদিনেই অচল হয়ে পড়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা।

২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকার ঢাকার ৪৩টি ট্রাফিক সিগন্যাল সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয় কেস প্রকল্পের আওতায়। এর ফলে শুধুমাত্র গুলশান দুই সিগন্যালে লাল ও সবুজ বাতি জ্বললেও বাকিগুলোর সবই অকেজো।


ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, গত দুই দশকে এসব প্রকল্পে শুধু ট্রাফিক ইন্টারসেকশন আর সিগন্যাল স্থাপনেই খরচ হয়েছে প্রায় পৌনে দুইশ কোটি টাকা। তবে এত টাকা খরচ করেও রাজধানীর সড়ক সংযোগে আসেনি নিয়ন্ত্রণ। অথচ ১১৫টির বেশি ট্রাফিক সিগন্যালসহ আরও ৫৫০টির মতো স্থানে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণের ভরসা হাতের ইশারা দিতে বাড়ানো হয়েছে পুলিশ। তথ্য বলছে, শুধু যানবাহন চলাচলের ইশারা দিতেই বছরে বিপুল সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশের বেতন দিতে সরকারের শত শত কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে। তবে আধুনিকায়ন করা গেলে সড়কের দুর্ঘটনা কমার সাথে ট্রাফিক পুলিশদের ঝুঁকি কমে আসবে, সাথে সরকারের বিপুল অর্থ ও জনশক্তি সঞ্চয় হবে।

এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশের গুলশান জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের প্রতিটি ইন্টারসেকশনে কম পক্ষে চার জন পুলিশ সদস্য কাজ করে। যদি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হয় সে ক্ষেত্রে আমাদের জনশক্তি কম অপচয় হবে পাশাপাশি আমাদের যে ঝুঁকি তা কমে আসবে।

এদিকে ঢাকার চারটি ইন্টারসেকশনে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিস্টেম বসানোর আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছিল ডিটিসিএ। এতে ব্যয় হয় ৫২ কোটি টাকা। দুই সিটি করপোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ চারটি স্থানে ইনটেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (আইটিএস) নিয়ে কাজ করে ডিটিসিএ। পরীক্ষামূলক ভাবে বসানো এসব কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ট্রাফিক লাইট উত্তর সিটি করপোরেশনের মহাখালী ও গুলশান-১ ইন্টারসেকশনে সফটওয়্যারের অভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রদর্শন হিসেবে। দক্ষিণের যন্ত্রপাতি তো খোয়া গেছে।


প্রশ্ন হলো দুই দশকে এত সব প্রকল্পের ব্যর্থতা কার? নতুন পরিকল্পনাই বা কি দুই সিটি করপোরেশনের?

দুই দশকে প্রায় পৌনে দুইশত কোটি টাকার সব প্রকল্পই ছিল পাইলট প্রকল্প। পাইলট প্রকল্পে সফলতা না আসায় মুল প্রকল্প নেওয়া হয়নি। তাই ব্যর্থতার কিছু নেই বলে জানিয়েছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট অফিসার মো. সেলিম খান বলেন, এর আগের সব প্রকল্পই ছিল পাইলট প্রকল্প। এখানে ব্যর্থতা বা সফলতার নয়। প্রকল্পগুলোতে ভালো সম্ভাবনা না থাকায় পরে মূল প্রকল্প নেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, আমরা আরও একটি পাইলট প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। এআই বেইজড। আশা করি আগামী দুই মাসের মধ্যে সফলতা আসবে। এর পর আমরা এটা নিয়ে কাজ করব।

এ বিষয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থার দেখভালের দায়িত্বে থাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দায়িত্বরত কারো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও উত্তর সিটি করপোরেশনের মাথাব্যথা নেই আগের প্রকল্প নিয়ে। তবে নতুন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম।

তিনি বলেন, আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পাইলটিং করছি গুলশান-২ এ। ইতোমধ্যে আমরা সফলতাও পেয়েছি। এবার ডিজিটাল নয় হবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বেইজড। এর পর যত প্রকল্প হবে । সব এআই দিয়ে চলবে। আমরা সে দিকে এগুচ্ছি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর