পহেলা মে আন্তর্জাতিকভাবে মহান শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে বিশ্বব্যাপী দিবসটিকে পালন করা হয়। গত ১৩৮ বছর ধরে দিবসটি পালন হয়ে আসলেও এনিয়ে কতটা জানেন শ্রমিকেরা, নিজেদের অধিকার নিয়েই বা কতটা সচেতন তারা?
রাজধানীর মিরপুরে রিকশা চালান ইলিয়াস মিয়া। এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে থাকেন বাগানবাড়ি বস্তিতে। রিকশা চালিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে কোন রকম ডাল-ভাত খেয়ে বাঁচতে পারলেও ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা করানোর সামর্থ্য নেই। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাড়তি খরচের লাগাম টানতে বন্ধ করেছেন ছেলের স্কুল। বয়স কম হলেও মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
মে দিবস কী জানেন না ইলিয়াস। এদিন নিয়ে জানতে চাইলে তার সরল উত্তর—'এইসব দিবস-টিবস দিয়া কী হইবো মামা। কাম করি, এতে যা টাহা পাই, এই দিয়া কোন রহম চলি। আজকে কামে না নামলে খাইতে পারুম না। আমাগো আর কি এসব দিয়া কোন কাম আছে? নিজের পেট, নিজের পরিবার নিজেরেই পালন লাগবো। কাম না করলে তো আর কেউ টাহা দিবো না, খাওন দিবো না।'
রিকশা চালানোও একটি কর্ম, সে ক্ষেত্রে আপনি আপনার কাজের মাধ্যমে কি সঠিক মূল্যায়ন পান এমন প্রশ্নের জবাবে বার্তা২৪.কমের এ প্রতিবেদককে ইলিয়াস বলেন, 'আমাগো লগে তো কেউ ভালা কইরা কথাও কয় না। এই যে গরমের মধ্যে রিকশা চালাই তাতেও কেউ বাড়তি টাহা দিবো না। ছোড-বড় সবাই তুই-তোহারি করে। কিন্তু পরিবার আছে, খাওন লাগবো এইজন্য কামও করা লাগবো। যে যা ব্যবহার করুক, কাম করা ছাড়া তো উপায় নাই।'
মিরপুর শাহ আলী প্লাজার সামনে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন শ্যামল দাস। আগে অন্য কাজ করলেও জুতা সেলাইয়ের কাজে আসছেন ছয় মাস আগে। জুতা সেলাইয়ের কাজে কেমন যাচ্ছে জীবন জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, 'সারা দিনে কাম যা অয় তাতে কোন রকম চলে যায়। আয় খারাপ না, কিন্তু জিনিসপত্রের দামও সব বাড়তাছে। এই জন্য একটু তো সমস্যা অয়, তারপরেও ভগবানের দয়ায় ভালই আছি।
মে দিবস সম্পর্কে কোন কিছু জানেন কিনা জানতে চাইলে মাথা নাড়িয়ে 'না' সূচক উত্তর দেন। জুতা সেলাইয়ের কাজ করে নিজের প্রাপ্য মর্যাদা পান কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে চেহারায় নেমে আসে এক রহস্যময় নীরবতা, মুখে যেন বিদ্রূপের হাসি। সে হাসিই যেন বলে দিচ্ছে কতটা সম্মান প্রাপ্য আর কতটা তিনি পান।
দেশে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এমন অগ্নিতাপে হাঁসফাঁস অবস্থা জনজীবনের। তবে এই শ্রমিকদের একটু থেমে স্বস্তিবোধের সময়টুকুও যেন নেই। তাই হিট অ্যালার্টকে এক পাশে সরিয়ে রেখে প্রতিদিন কর্মের তাগিদে বেরুচ্ছেন রাস্তায়। পরের দিনের আহার জোগাড়ে নামছেন কাজে। এর অন্যথা হলে যে পরের বেলা অনাহারে কাটবে পরিবারের।
শেওড়াপাড়ায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন সুফিয়া খাতুন। বাবা-মার আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় বিয়ে দিয়েছেন অল্প বয়সে। বিয়ের পর গার্মেন্টসকর্মী স্বামীর একা আয়ে সংসার না চলায় কাজে যোগ দিয়েছেন নিজেও। দুজনের আয়ে কোনোরকমে সংসার চলে।
সুফিয়া খাতুনের কাছে মে দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, হ্যাঁ, আজকে শ্রম দিবস শুনছি। এই জন্য আজকে কারখানা ছুটি। এই দিবস নিয়ে কিছু জানেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর বেশি কিছু জানি না।
গার্মেন্টসকর্মী হিসেবে আপনার কাজের যথাযথ মূল্যায়ন কি হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পেট চালাইতে হলে কাজ করতে হবে। এছাড়া তো আর কোন উপায় নাই। কেউ তো আর বাসায় এনে খাবার দিয়ে যাবে না। তবে যে পরিশ্রম সে তুলনায় টাকা পাই না। যদি ঠিকমতো বাসা ভাড়া দিয়ে খেয়ে থাকতে না পারি, তাহলে প্রাপ্য মজুরি হলো কি করে? এর আগে আরেকটা গার্মেন্টসে কাজ করতাম হঠাৎ করে কোন বেতন না দিয়েই বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আবার এখানে ঢুকছি। এইভাবেই কোন রকম চলতেছে।
রাজধানীজুড়ে এমন প্রায় ১৮-২০ জন শ্রমিকের সাথে কথা বলেন বার্তা২৪.কমের এ প্রতিবেদক। তবে তাদের অধিকাংশই বলতে পারেননি শ্রম দিবস কী, এই দিনটি কেন পালন করা হয়। তবে কেউ কেউ শ্রম দিবসের কথা শুনলেও এর চেয়ে বেশি কিছু জানেন না বলে জানান।
মে দিবসে এই দিনেও তপ্ত রোদ মাথায় নিয়ে এই শহরের শ্রমজীবী মানুষ বের হয়েছেন কাজে। কাজ শেষে সন্ধ্যা বা রাতে সওদা নিয়ে বাসায় ফিরলে তবেই জ্বলবে চুলায় আগুন। তাই তাদের কাছে কোন দিবস নয়, বরং মাথার উপর টিনের চালা আর পেটে ভাত এই যেন প্রতিদিনের, প্রতিবেলার কামনা। তাই তো শীত, গ্রীষ্ম বা বর্ষা যাই হোক, কখনোই থামে না তাদের ছুটে চলা।