শাহজাহান মিয়ার বাড়ি ভোলায়। পেটের দায়ে এসেছেন চট্টগ্রামের কর্ণফুলী তীরে। যখন যা পান তাই করে খেয়ে বাঁচা শারীরিকভাবে অসুস্থ শাহজাহানের ছোট মেয়ের নাম মোর্শেদা। বাবার সাথে সে জীবন সংগ্রামে যুক্ত হয়েছে আরও আগেই! বিভিন্ন আড়তে পঁচে পোকায় ধরা পেয়াজ কম দামে কিনে এনে রোদে শুকানোর সময় চাক্তাই খালের পাড়ে দেখা মিলেছে এই বাবা-মেয়ের।
কথা হয় বাবা শাহজাহান মিয়ার সাথে। ১১ বছরের এতো অল্প বয়সের মেয়েকে পড়ালেখায় না পাঠিয়ে নিজের সাথে রেখে কাজ করানোর বিষয়ে শাহজাহান মিয়াকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ’আমাগোতো সংসার চলা লাগবো। সংসার না চললে মাইয়ারে পড়ালেখা করামু কী দিয়া। টেকা পয়সার লাগি মাইয়ারে পড়ালেখা করাইতে পারি না। মাইয়া ফাইভ পর্যন্ত পড়ছে।’
অপু, আরাফাত ও আজগর তিন বন্ধু। তাদের বয়স যথাক্রমে ১২, ১১ ও ১২ বছর। তাদের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজিতে। রহমতগঞ্জ বাই লেইনের একটি ‘প্রিন্টিং এন্ড ফয়েল পেপার কাটিং হাউস’— এ কর্মরত অবস্থায় দেখা মিলে এই তিন বন্ধুর সঙ্গে।
এতো অল্প বয়সে তিন বন্ধুর এই শ্রমজীবনের গল্প জানতে চাইলে তারা বিনিময় করে এক করুণ অভিজ্ঞতা। তাদের তিনজনেরই গল্প এক। তারা জানায়, তাদের বাবা-মায়েরাই তদেরকে এই পেশায় পাঠিয়েছে আয়-রোজগারের জন্য। তবে, তিনজনের বেতন মিলিয়েও অযুতের ঘর ছুঁতে পারেনি।
উপরোক্ত গল্প দু’টিতে যে শিশুদের চিত্রায়ণ করা হয়েছে, আমাদের দেশে বর্তমানে সেসব শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭ জনে। যা বাংলাদেশের মোট শ্রমের ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এরমধ্যে চট্টগ্রামে নিয়োজিত রয়েছে ৬ লাখ ৪০ হাজার শিশু। যা বাংলাদেশের মোট শিশুশ্রমের ৩৬ শতাংশ।
সরকারি তথ্য মতে, দেশের ১৭ লাখ ৭৬ হাজার শিশু শ্রমিকের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বাধিক সংখ্যা রয়েছে। ৩ লাখ ৪০ হাজার শিশুশ্রমিক নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ঢাকা বিভাগে। গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রামে শিশুশ্রমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে মোট শিশুশ্রম ছিলো ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এবছর সেটা বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
চট্টগ্রামের শিশুরা গৃহস্থালীর কাজসহ ডাম্পিং স্টেশন, ড্রাই ফিশ সেক্টর, মেটাল ফ্যাক্টরি, অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, পরিবহন এবং জাহাজ ভাঙার কাজে জড়িত। যার কারণে তাদের জীবনের ঝুঁকিও ব্যাপক।
সোমবার (২৯ এপ্রিল) চট্টগ্রামের অলাভজনক সংস্থা (এনজিও) ’মমতা’র সহকারী পরিচালক (শিশু সুরক্ষা প্রকল্প) মুজতাহিদা কাউসার বার্তা২৪.কমকে এসব তথ্য প্রদান করেন।
তবে, চট্টগ্রামে শিশুশ্রমের শীর্ষে রয়েছে এলুমিনিয়াম খাত। এরপর যথাক্রমে গণপরিবহন, হোটেল, পোশাক শিল্প, নির্মাণ, স্বাস্থ্য ও বিউটি পার্লার খাত রয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজের (বিলস) সহায়তায় ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষকের পরিচালনা করা জরিপে এসব তথ্য উঠে আসে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর তথ্যমতে (বিবিএস), বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ৪৩টি সেক্টরকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো থেকে জানা যায়, এ ঝুঁকিপূর্ণ পেশাগুলোতেই সবচেয়ে বেশি মিশু কাজ করে থাকে।
মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন (বিএইচআরএফ) এর মহাসচিব জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘রাষ্ট্রের বিভিন্ন আইনে শিশুর বিভিন্ন সংজ্ঞা দেওয়া হলেও অধিকাংশ আইনে একজনকে ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু বলা হয়। ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু শ্রম আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কোন কোন ক্ষেত্রে শিশুদের নির্দিষ্ট বয়স ও শর্ত অনুসারে শ্রমের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে, দুঃখের বিষয় হলো পাশের দেশ ভারতেও শিশু সুরক্ষা আইন আছে। কিন্তু বাংলাদেশে নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটা নির্দিষ্ট শিশুদের কাজের অনুমতি থাকলেও এর কিছু শর্ত আছে। যেমন- দৈনিক ৪-৫ ঘন্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। ভারী কাজ করানো যাবে না। কেমিক্যাল, ব্যাটারি, ওয়ার্কশপ, ওয়্যারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল, পরিবহন, ডাম্পিং ইত্যাদি ভারী কাজ করানো যাবে না। ফুলটাইম কাজ করানো যাবে না। তাদের ফিটনেস পরীক্ষা করে তাদের নিয়োগ দিতে হবে ইত্যাদি। তবে, হতাশার কথা হলো- শিশুর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্র দায়িত্ব হলেও রাষ্ট্র তা পালন করছে না।’
শিশুরা কেনো শিশুশ্রমে জড়াচ্ছে? এর পেছনে কী কারণ রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রামের অলাভজনক সংস্থা (এনজিও) ’মমতা’র প্রধান নির্বাহী রফিক আহামদ বলেন, ’চট্টগ্রামে শিশু শ্রম বাড়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে দারিদ্র। তাছাড়া, চট্টগ্রাম বানিজ্যিক রাজধানী হওয়ার কারণে অনেকেই ছোটবেলা থেকেই কাজের সাথে জড়িয়ে যান। আবার শিশুদের পারিশ্রমিক কম দেওয়া যায় বলে অনেক প্রতিষ্টান মালিক শিশুদের নিয়ে এসে কাজে লাগিয়ে দেয়। এছাড়াও আরও বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে, সবচেয়ে বড় কারণ হলো দারিদ্র। রাষ্ট্র সবার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারলে এই শিশু শ্রম কমবে বলে আশাবাদী।’
ইলমা (এনসিওর লিগ্যাল সাপোর্ট থ্রো লোকাল মুভমেন্ট এন্ড একশান) এর প্রধান নির্বাহী জেসমিন সুলতানা পারু বলেন, ’আমাদের জনসংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এটাও শিশু শ্রম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। তাছাড়া অনেক পরিবার ছেলেমেয়েদের টাকার জন্য কাজে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু শিশু শ্রম তো শুধু শিশু শ্রম না। এই শিশু শ্রম করতে গিয়ে যে শিশুরা কীরকম শারীরিক ও মানসিক হেনস্তার শিকার হয় তা কল্পনারও বাহিরে। তাছাড়া, সরকার বলছে, একটা শিশুও পিছনে পড়ে থাকবে না। একটা শিশুও রাস্তায় থাকবে না। কিন্তু বললে কী হবে, সেরকম তো কোন উদ্যোগ নেই। শিশু কই আছে, মরে গেছে না বেঁচে আছে, সে খবর কেউ রাখে না। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারিভাবে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করলে, পদক্ষেপ নিলে শিশু শ্রম একদিন কমে আসবে বলে আমি মনে করি।’