'আমাদের জিম্মিদশার দিনগুলা ভাল ছিল না, এসব দিনের কথা আমরা আর মনে করতে চাই না। সবাই আজকের এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। সবাইকে একসঙ্গে দেখে আরও বেশি ভালো লাগছে। সারা বাংলাদেশের মানুষজন আমাদের জন্য দোয়া করেছেন। সবার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা, বলার মত আর কিছু নেই। আমাদের এই মুক্তির বিষয়ে যারা কাজ করেছেন সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা। বিশেষ কৃতজ্ঞতা আমাদের কোম্পানি কেএসআরএম, সরকারপক্ষ ও মিডিয়া কর্তৃপক্ষসহ পুরো বাংলাদেশ এর যারা আমাদের জন্য দোয়া করেছেন।'
মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকেল ৪টায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসে কেএসআরএমের মালিকানাধীন লাইটার জাহাজ এমভি জাহান মনিতে দাঁড়িয়ে বার্তা২৪.কমকে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন সোমালিয়ান জলদস্যু কর্তৃক জিম্মি হওয়া জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহর প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ খান।
এরপর জাহাজ থেকে মাটিতে পা রাখতেই প্রথমে নিজের দুই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেন তিনি। অনুভূতির কথা জানতে চাইলে আতিক উল্লাহ খান বলেন, 'অনেক ভালো লাগছে, যা বলে প্রকাশ করার মতো না। দ্বিতীয়বার জীবন পেলে মানুষের যে অনুভূতি জন্মায়, সেই অনুভূতিই এখন কাজ করছে। বড় একটি গর্বের বিষয় ছিল, যখন জলদস্যুদের থেকে লুকিয়ে জাহাজে ফেসবুক চালাতাম। তখন দেখতাম, সারা বাংলাদেশের মানুষ আমাদের জন্য দোয়া করছে। যেটি আমাদের মনোবল অনেক অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা এটাই ভেবে তখন মনকে সান্ত্বনা দিয়েছিলাম যে, আমাদের পরিবারের সঙ্গে সারা বাংলাদেশের মানুষ আছে।'
জিম্মি অবস্থায় জীবনের নিশ্চয়তা নিয়ে কতটুক শঙ্কিত ছিলেন?- এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, 'ওরকম তেমন বেশি অনিশ্চয়তা ছিল না। আমরা আগে থেকে জানতাম, আমাদের কোম্পানিতে আগেও একবার এরকম জাহাজে জলদস্যুর আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। সে সময় ওই নাবিকদের কোপাম্পানি ছাড়িয়ে এনেছে। সেটির অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের একটি আশা ছিল, কোম্পানিও আমাদেরকে ছাড়িয়ে নিবে। আমাদের মধ্যে এই আস্থাটা ছিল। কিন্তু কবে দেশে ফিরব সেটি নিয়ে একটি অনিশ্চয়তা ছিল। তারপরও সবার প্রচেষ্টা এবং দোয়াতে আল্লাহর রহমতে মাত্র এক মাসের মধ্যে আমরা মুক্ত হয়েছি। তবে এত তাড়াতাড়ি যে ফিরতে পারব সেটি আশা করিনি।'
জিম্মি অবস্থার পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে প্রধান কর্মকর্তা আতিক উল্লাহ খান বলেন, 'আমরা একে-৪৭ এর নাম শুনেছি, অথবা টিভিতে দেখেছি। কিন্তু সরাসরি কখনো দেখিনি। জিম্মি অবস্থায় দেখলাম, জাহাজে সেই একে-৪৭ আমার দিকে তাক করে আছে। পরিস্থিতিটা অবশ্যই অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ছিল। সে সময়ে আমরা মনে মনে দোয়া করেছি, ধৈর্য ধরেছি এবং আল্লাহর প্রতি আস্থা রেখেছি। এভাবেই জাহাজের দিনগুলো কেটেছে। অনেক ভয়ঙ্কর ছিল। এসব দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। জলদস্যুরা অনেক বড় বড় মেশিনগানও এনেছিল। তবে মাঝেমধ্যে তারা যখন ফায়ার করতো, আমরা অনেকে ঘুম থেকে সজাগ হয়ে যেতাম। ওই সময়টিতে অনেক ভয় লাগতো।
ছোট্ট দুইমেয়ে কোলে নিয়ে আতিক উল্লাহ বলেন, 'আমার দুই মেয়ে প্রথমে আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরেছে। ওরা দুইজনেই খুবই আনন্দিত। এর আগেও আমি যদি জাহাজে যেতাম, তখন থেকে তারা- বলে বাবা কখন আসবে। এখানে সবাই আসতে পারেনি, বাসায় পরিবারের অনেকজন অপেক্ষা করছে। আমরাও তাদের দিকে মুখিয়ে আছি।'
এদিকে দীর্য়দিন পর বাবাকে কাছে পেয়ে খুশি আতিক উল্লাহর দুই মেয়ে। বড় মেয়ে ইয়াশরা ফাতেমা বলে, 'বাবাকে পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। সামনে ২৩ তারিখ থেকে আমাদের পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হলে বাবাকে নিয়ে ঘুরতে যাব। ঈদের সময় তেমন বেড়াতে পারিনি। এবার বাবাকে নিয়ে বেড়াবো।'
এদিন বিকেল চারটায় ২৩ নাবিককে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি-১ জেটিতে ভিড়ে লাইটার জাহার এমভি জাহান মনি। এর কয়েক ঘন্টা আগে থেকেই নাবিকদের এক নজর দেখতে বন্দর জেটিতে ভিড় করেছেন নাবিকের স্বজনরাসহ শতশত মানুষ।
মঙ্গলবার সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে কুতুবদিয়া থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের উদ্দেশে ২৩ নাবিক নিয়ে রওনা দেয় এমভি জাহান মনি-৩। বিকেল চারটায় অবসান হয় অপেক্ষার দীর্ঘ দুমাসের অপেক্ষার। এর মধ্যেই শুরু হয় নাবিকদের বরণের উৎসব। লাল রঙের জাহাজটি বন্দরে ভিড়ার কয়েক মিনিট আগে থেকেই নাবিকরা দূর থেকে হাত নেড়ে জানান দেন, আমরা এসেছি! এদিকে জেটিতে থাকা স্বজনরাসহ সকলে তাদেরকে হাত উঁচিয়ে স্বাগত জানায়। এরপর ৪টা ১৮ মিনিটের দিকে জাহাজ থেকে একে একে নেমে আসেন ২৩ নাবিক। নাবিকদের বরণ করে নেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করেছিলেন নাবিকদের পরিবারের সদস্যরা। নাবিকদের কাছে পেয়ে আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয় জেটি এলাকায়।
এর আগে সোমবার (১৩ মে) বিকেল ৬টায় বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়া চ্যানেলে ২৩ নাবিকসহ নোঙর করে এমভি আব্দুল্লাহ।
এমভি আব্দুল্লাহতে ছিলেন যে ২৩ নাবিক:
জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার মো. আতিক উল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এএসএম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ, এবি পদের মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসাইন, জয় মাহমুদ, ওএস পদের মো. নাজমুল হক, অয়েলার পদের আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশাররফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম, জিএস পদের মোহাম্মদ নুর উদ্দিন ও ফিটার মোহাম্মদ সালেহ আহমদ।
আগে ১২ মার্চ মোজাম্বিকের মাপুতো বন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আসার পথে ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুর কবলে পড়ে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প গ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন জাহাজটি ৩২ দিন জলদস্যুর কাছে জিম্মি থাকে। এরপর ১৪ এপ্রিল মুক্তিপণ দেওয়ায় জাহাজ থেকে নেমে যায় জলদস্যুরা।