কড়াইল বস্তিতে অদৃশ্য সীমানা, পা বাড়ালেই বিপদ!

, জাতীয়

আল-আমিন রাজু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা | 2024-05-18 21:42:18

মো. রিফাত হোসেন (১৮)। স্কুল শিক্ষার্থী। রাজধানীর কড়াইল বস্তি এলাকার বাসিন্দা। গত ১৪ মার্চ ভোররাতে সেহরির সময় মা দুধ-ভাত খেতে চাইলে রিফাত বের হন কাছে-ধারের দোকান থেকে দুধ কিনতে। সেখানে রিফাতের ওপর হামলা হয়। রিফাতকে ধরে নিয়ে যায় প্রতিপক্ষের লোকজন। রাতের আঁধারেই মারধর ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে বুকে-পিঠে ও শরীরে বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে। গুরুতর জখম অবস্থায় রিফাতকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এ যাত্রায় বেঁচে যান রিফাত।

রিফাত প্রাণে বাঁচলেও বেঁচে ফেরা হয়নি একই এলাকার আল-আমিনের। মৃত মোসলেম উদ্দিনের ছেলে আল-আমিন ছিলেন পেশায় মুদি দোকানি। সেদিন ছিলো ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট। বড় দুই ভাইয়ের সঙ্গে স্থানীয় নূরানী মসজিদে এশার নামাজ আদায়ে গিয়েছিলেন আল-আমিন। নামাজরত অবস্থায় হামলার শিকার হন তিনি।

নামাজে দাঁড়িয়ে প্রথম রাকাত শেষ করে দ্বিতীয় সিজদা আর দেওয়া হয়নি আল-আমিনের। অতর্কিত পেছন থেকে হামলা চালানো হয় তার ওপর। মসজিদের ভেতর জখম করার পর তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে হাতে পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। শরীর থেকে সকল রক্ত বের করে দিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে প্রতিপক্ষ। ওই হামলায় জখম হন তার ভাই নাসির হোসেনও। আর মসজিদের সামনের কাতারে থাকায় সেই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান তাদের আরেক বড় ভাই জুয়েল সরকার। তবে গুরুতর আহত হয়ে প্রাণে বাঁচলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি নাসির। মাথায় জখম নিয়ে এখন শুধুই স্মৃতি হাতড়ান। পুরোপুরি পরনির্ভরশীল এখন নাসিরের জীবন।


রাজধানীর ভেতরে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে দীর্ঘ পরিচয় এই কড়াইল বস্তি এলাকার। একদিকে অভিজাত এলাকা বনানী, যেখানে উচ্চবিত্ত ও অভিজাত পরিবারের বসবাস। তারই মাঝে টিএনটি কলোনী ঘিরে গড়ে উঠেছে এই কড়াইল বস্তি। সেখানে লাখো সুবিধা বঞ্চিত ও নিম্ন আয়ের মানুষের বাস। এ যেন বাতির নিচে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে খেটে খাওয়া মানুষের আড়ালে সন্ত্রাস ও সহিংসতার যে ভয়াল পরিস্থিতি তারই একটি খণ্ডচিত্র এই রিফাতের ওপর হামলা কিংবা আল-আমিন হত্যা।

এখানে সন্ত্রাসের সাথে মিশে আছে রাজনীতির কালো ছায়া। এলাকায় প্রভাব খাটানোই কেবল নয়- ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের রাজনীতি ও পদপদবীর দ্বন্দ্বের জেরেও এখানে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। অস্ত্রের ঝনঝনানি আর কথায় কথায় হামলা, হত্যা, জখম এখানকার নিত্যাচিত্র। আরও ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে এসব সংঘর্ষ, হত্যা-হামালার অধিকাংশ তথ্য নেই থানা পুলিশের নথিতে। অথচ সহিংসতায় জড়িত অনেকেই জনসম্মুখে ঘুরে বেড়ায়।

এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় ১৪ মার্চে হামলার শিকার রিফাতের সঙ্গে। রিফাত বলেন, "আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসলাম। মামলা করলাম। পুলিশ এপর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করেনি। সব আসামি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বরং তারা এখন নানাভাবে আমাকে ও আমার ছোট ভাইকেও হত্যার হুমকি দিচ্ছে। জীবন সঙ্কায় দিনপার করছি।"


হামলার রাতে কি ঘটেছিলো জানতে চাইলে রিফাত বলেন, মারুফ নামের একটি ছেলে এসে আমাকে ডেকে মাঠের দিকে নিয়ে যায়। মাঠে যাওয়ার পরেই অতর্কিত হামলা চালায় তানভীর, তুহিন, মাহবুব, মাসুদ, সুমনসহ বেশ কয়েকজন। ধারালো চাকু ও খুর দিয়ে পোচ দেয়। এছাড়া হাতুরি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন স্থানে থেতলে দেয় হামলাকারীরা।

নিহত আল আমিনের ভাই জুয়েল সরকারের সঙ্গেও কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়, জুয়েল সরকার নিজেই এখানকার একটি দলের প্রধান। প্রতিপক্ষের এই হামলার টার্গেট ছিলেন তিনি। যা জুয়েল নিজেও স্বীকার করেন। তিনি বলেন, "মূলত আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই হামলা চালিয়েছিলো। আমি নামাজের কাতারের সামনের দিকে থাকায় পেছনে থাকা আমার দুই ভাই হামলাকারীদের রোষের মুখে পড়ে। সে রাতে আমার ভাইদের রক্তে পবিত্র মসজিদের মেঝে লাল হয়ে যায়।"

জুয়েল বলেন, "আহত অবস্থায় আমার ছোট ভাই আল আমিনকে ধরে নিয়ে হাতের রগ কেটে দেয়। পর আমরা তাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করি।"

জুয়েল জানান, এই ঘটনায় তিনি নিজে বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলার প্রধান আসামিকে পরে গ্রেফতার করা হলেও মাত্র আাড়াই মাসে জামিনে বের হয়ে আসে। সেই আসামি এখন আবার নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে, বলেন জুয়েল। 

প্রায় ১৯০ একর সরকারি ও ব্যক্তি-মালিকানাধীন জমির ওপর গড়ে উঠেছে এই কড়াইল বস্তি। বস্তিতে অন্তত চার লাখ মানুষের বসবাস। যার অধিকাংশই দিনমজুর ও শ্রমজীবী। কড়াইল বস্তিতে রাজনৈতিক নামধারী নেতাদের আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার করছেন বস্তিবাসীদেরই। এখানকার তরুণ ও কিশোরদিয়েই গড়ে তোলা হচ্ছে সন্ত্রাসে ব্যবহারের জন্য। নিজেদের ক্ষমতার জানান দিতে শুধু দেশীয় অস্ত্র নয়, হরহামেশাই তারা ব্যবহার করছে আগ্নেয়াস্ত্র। সাম্প্রতিক সময়ে এই সন্ত্রাসী কাজে তারা সামাজিক মাধ্যমও ব্যবহার করছেন।  অস্ত্রসহ ফেসবুকে ছবি প্রকাশ করে প্রতিপক্ষকেও হুমকিও দেওয়া হচ্ছে- এমন নজিরও রয়েছে।

সূত্র বলছে, কড়াইল বস্তিতে অন্তত পাঁচটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয়। প্রতিটি গ্রুপের সদস্য সংখ্যা শতাধিক। তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় দুই রাজনৈতিক নেতা। একজন কড়াইল বস্তির বাসিন্দা ও বনানী থানার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুর আলম নুরু। আরেকজন বনানীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের (প্রস্তাবিত) যুবলীগের কড়াইল ১ নং ইউনিটের সাবেক সভাপতি জুয়েল সরকার। নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে অস্ত্রের মহড়া ও প্রতিপক্ষের লোকজনের ওপর হামলার ঘটনা নিত্য দিনের। তবে যে কোনো হামলার পর দুই পক্ষই একে অপরের ওপর দায় চাপায়।

কড়াইল বস্তি এলাকায় এক ত্রাসের নাম নুর আলম নুরু

অনুসন্ধানে জানা যায়, কড়াইল বস্তি এলাকায় এক ত্রাসের নাম নুর আলম নুরু। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নুরু ও তার লোকজন নিয়মিত অস্ত্রের ছবি প্রকাশ করেন। তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ। মসজিদে নামজরত অবস্থায় প্রতিপক্ষের ওপর হামলা চালান তিনি। যে হামলায় নিহত হয় আল আমিন।

ওই ঘটনায় মামলা হলে গ্রেফতার হন নুরু। মাত্র আড়াই মাস জেল খেটে মুক্তি পান। জেল থেকে এলাকায় ফেরার পথে বিশাল মহড়া দিতে দেখা যায় তাকে। অভিযোগ আছে কড়াইল বস্তি এলাকায় অধিকাংশ মাদকের স্পট নিয়ন্ত্রণ করেন নুরু। তার পরিবারের অন্তত ২৫ জন সদস্য মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর এই মাদকের ব্যবসা নিরাপদ করতেই সার্বক্ষণিক কড়াইল বস্তি এলাকার প্রবেশ পথে নজরদারি থাকে তার বাহিনীর লোকজনের।

কড়াইল বস্তির আরেকটি অংশের নেতৃত্বদেন যুবলীগ নেতা জুয়েল সরকার। স্থানীয় নূর মসজিদের সভাপতি দায়িত্ব পালন করা জুয়েলের দাবি রাজনীতির দ্বন্দ্বে তার পরিবারের ওপর বারবার হামলা চালিয়ে আসছে প্রতিপক্ষের লোকজন। তাই আত্মরক্ষার্থে এলাকায় মহড়া দেন। সূত্র নিশ্চিত করেছে তার নিয়ন্ত্রণেও একাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে।


নুরুর সঙ্গে দ্বন্দ্বের বিষয়ে জানতে চাইলে জুয়েল সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেন, রাজনীতি করতে গিয়ে শত্রুতা তৈরি হয়। একটা সময়ে আমরা এক সঙ্গে রাজনীতি করতাম। নিজেকে বড় নেতা ভেবে আমাদের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করে নুরু। এরপর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা সময়ে আমাদের ওপর হামলা চালায়। ২০২২ সালের ১৭ আগস্ট নুরু বাহিনীর হামলার মসজিদের ভেতরে আমার দুই ভাইকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। একজন বেঁচে ফিরলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি।

গত ১১ মে রাজধানীর বনানীর কড়াইল বস্তি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বস্তির দক্ষিণ অংশ ও বনানী লেকপাড় অংশের মধ্যে এক অদৃশ্য সীমানা। দুই পক্ষের কেউই ভুলেও সীমানার ওপারটা মারান না। এমন কি নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় চলাচলের ক্ষেত্রেও থাকেন সতর্ক। কারণ রাতের অন্ধকারে যে কোনো সময় প্রতিপক্ষের লোকজন হামলা চালাতে পারে।

সম্প্রতি রাতের অন্ধকারে ধরে নিয়ে জুয়েল গ্রুপের সদস্য আসিফের ওপর নির্যাতন চালায় নুরু বাহিনীর সদস্যরা। ধারালো খুর দিয়ে আসিফের গাল কেটে দেওয়া হয়। এই আসিফ নিজেও একটি কিশোর গ্যাং গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন।

গাল কেটে যাওয়ায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না  জানিয়ে আসিফ বার্তা২৪.কমকে বলেন, মসজিদে হামলা চালিয়ে ও পরে তুলে নিয়ে আল আমিনকে হত্যা করে নুরু বাহিনীর সদস্যরা। পরবর্তীতে নুরু বাহিনীর বিচারের দাবিতে  মানববন্ধনে অংশ নেওয়াই আমার কাল হয়েছে। বাসা থেকে বের হতে পারি না। এখন পর্যন্ত ১৫/১৬ বার হামলা হয়েছে। গাল কেটে ফেলেছে। মাথায় যে কত কাটা দাগ তার কোনো হিসাব নেই। নিয়মিত হত্যার হুমকি পাচ্ছি।

আসিফের দাবি, মহাখালী বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে ক্লিনারের কাজ করতেন। কিন্তু গালের কাটা দাগের কারণে অফিসে যেতে পারেন না। কারণ অফিসের মানুষ তাকে দেখলে ভয় পায়।

এদিকে, বিভিন্ন সূত্রে দুই গ্রুপের অর্ধশতাধিক ছবি ও ভিডিও এসেছে বার্তা২৪.কমের হাতে। ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভিডিও-নির্ভর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক ও ফেসবুকে নিয়মিত অস্ত্রের ছবি পোস্ট দেন দুই গ্রুপের সদস্যরা। দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি নুরুর বিদেশি অস্ত্রসহ ছবিও রয়েছে। এছাড়া এলাকায় নিয়মিত দলবল নিয়ে মহড়া গ্রুপের নেতারা। যার ছবি ও ভিডিও রয়েছে। এমন কি নুরু বাহিনীর সদস্যদের বনানী থানা পুলিশ আটক করে থানার সেলে রাখলে সেখানেও তারা ছবি ও টিকটক ভিডিও তৈরি করে নিজেদের আধিপত্য জানান দেন। দুই গ্রুপই বিভিন্ন ঘটনায় পাল্টাপাল্টি একাধিক মামলা করেছে।

কড়াইল বস্তিতে দুই গ্রুপের অস্ত্রের মহড়া ও কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য বিস্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী সাহান হক বলেন, আমরা ইতোমধ্যে মামলা নিয়েছি। আসামি গ্রেফতার করেছি। যারা এ ধরনের কাজে জড়িত আছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।

স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা পরিচয়ে আধিপত্য বিস্তার করা নুরু নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্র পোস্ট করছেন। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি সাহান বলেন, "অস্ত্রের ছবি পোস্ট দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনার কাছে তথ্য থাকলে আমাকে পাঠান আমি দেখবো।"

এ সম্পর্কিত আরও খবর