ভূমিদস্যুর পেটে ময়ূর নদ

খুলনা, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, খুলনা, বার্তা২৪.কম | 2023-08-28 02:27:39

দখল আর দূষণের ফলে মৃতপ্রায় খুলনার ময়ূর নদ। খুলনা নগরীর একটি প্রবেশদ্বার গল্লামারীর পাশ দিয়ে বয়ে চলা এ নদটির অস্তিত্ব আজ বিলীনের পথে। অবৈধ ভাবে দখল করে নদের গল্লামারী অংশের ব্রিজের পশ্চিম পাশে মার্কেট নির্মাণের কাজ করছে একটি মহল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় নদীর মূল অংশ গিলে খাচ্ছে ভূমিদস্যুরা।

মঙ্গলবার (২২ জানুয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুরাতন গল্লামারী ব্রিজের পশ্চিম পাশে ময়ূর নদের মূল অংশের প্রায় ৩০-৩৫ ফুট দখল করে বালু ও মাটি ভরাটের কাজ চলছে। শ্রমিকরা দ্রুত গতিতে বালি ও মাটি ভরাটের কাজ করছে। নদের এ অংশে মার্কেট নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করছে আলোকিত মুকুল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান রকিবুল জাহিদ মুকুল।

আলোকিত মুকুল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান রকিবুল জাহিদ মুকুল বলেন, ‘আমি আমার জমিতে মার্কেট তৈরি করছি। ময়ূর নদের জায়গা দখল করিনি। যদি এক ইঞ্চি জায়গাও আমার মার্কেটের মধ্যে পড়ে, তাহলে আমি সেই জায়গা ছেড়ে দেব।’

নদী দখলের ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সারোয়ার আহমেদ সালেহীন বলেন, ‘বিষয়টি আমরাও শুনেছি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরেজমিনে তদন্তের জন্য লোক পাঠানো হয়েছিল। আমরা কাজ বন্ধ রাখতে বলেছি। এরপর কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’

এদিকে খুলনা সিটি করপোরেশনের খাল দখল ও অবৈধ উচ্ছেদ অভিযান ও বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির খাল দখল মুক্তকরণের দাবিতে চলমান আন্দোলনের সময় নদ দখলের এমন ঘটনায় হতাশ কর্মীরা। এছাড়াও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে উন্নয়নকর্মী ও পরিবেশবাদীরা।

বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ-উজ জামান বলেন, ‘দখল ও দূষণের কারণে ময়ূর নদ অনেক আগেই নাব্যতা হারিয়েছে। নদী ও খালের দখল দূষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালে হঠাৎ করে নদের পাড়ে দখলদারদের আনাগোনা বেড়েছে। এটা সত্যিই খুব দুঃখজনক। তাছাড়া এ নদের পানি অনেক আগেই ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। আমরা বিভিন্ন সময়ে নদ রক্ষার জন্য প্রশাসনকে জানিয়েছি। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ভূমিদস্যুরা নদ খেয়ে ফেলবে।’

উন্নয়নকর্মী জনউদ্যোগের সদস্য সচিব মহেন্দ্র নাথ সেন জানান, ময়ূর নদের দুই পাড় থেকেই সরকারি-বেসরকারিভাবে দখলযজ্ঞ চলছে। এ নদটিকে বাঁচাতে হলে খুলনার ২২টি খালের উপর থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে হবে।

২২টি খালের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- নিরালা, মান্দার, ক্ষেত্রখালী, মতিয়াখালী, লবণচরা, তালতলা, মিস্ত্রিপাড়া, নবীনগর, ছড়িছড়া, লবণচরা গোড়া, লবণচরা গেট, সবুজ বাগ, মিয়াপাড়া পাইপের মোড়, বাস টার্মিনালের পশ্চিম পাশ, রায়ের মহল পশ্চিমপাড়া, বাস্তুহারা, গল্লামারী নর্থ, দেয়ানা দক্ষিণপাড়া, বাটকেমারী, সাহেব খালী, হাজী তমিজ উদ্দিন, নারকেলবাড়িয়া, সুড়িমারি, ডুবি, বেতবুনিয়া, দেয়ানা, তেঁতুলতলা দশগেট, হাতিয়া, মাথাভাঙ্গা, মাস্টারপাড়া, হরিণটানা, খুদে, মজুমদার, কাদের, চকমথুরাবাদ, কাস্টমঘাট, নবপল্লী, ছোট বয়রা শ্মশানঘাট, রায়ের মহল মোল্লাপাড়া ও বিল পাবলা খাল। এসব খালের অধিকাংশই প্রভাব খাটিয়ে দখল করে স্থায়ীভাবে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন প্রভাবশালীরা। অবিলম্বে দখলদারদের উচ্ছেদের দাবি জানান তিনি।

ময়ূর নদের অদূরে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি) অবস্থিত। এ নদের উপর দিয়েই প্রতিদিন সহস্রাধিক শিক্ষার্থী খুবি ক্যাম্পাসে যাতায়াত করে। নদের দূষণ, দখল আর দুর্গন্ধের কারণে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরাও।

গল্লামারী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তফা আল মামুন প্রবাল জানান, ময়ূর নদটি আগে খরস্রোতা ছিল। অবৈধ দখলদারদের কারণে ময়ূর নদ এখন খালের মতো। এ নদটি খুলনা নগরের হৃৎপিণ্ড। প্রতি মুহূর্তে দখলের কারণে নদের আয়তন সংকুচিত হচ্ছে। দূষণে পানির চেহারাও বুড়িগঙ্গার মতো কুচকুচে কালো। দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় না। জলজ প্রাণী বেঁচে থাকার মতো পর্যাপ্ত অক্সিজেন (ডিও) নেই এই নদে। এলাকাবাসীর পক্ষে দ্রুত নদটি রক্ষার দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী অ্যাড. বাবুল হাওলাদার জানান, মানুষের দখল-দূষণে ময়ূর নদ মৃতপ্রায়। দ্রুত নদী উদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে তা খুলনাবাসীর জন্য খারাপ পরিণাম বয়ে আনবে।

উল্লেখ্য, ময়ূর নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে ৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০১৬ সালে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি)। তাতে পুরোপুরি দখল মুক্ত হয়নি নগরীর খালগুলো। এছাড়া ২০০৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি অবৈধভাবে খাল দখলকারীদের মধ্যে ৮১ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল। মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ৫০টি নদী ও খালের মালিক জেলা প্রশাসন। এগুলো তদারকি করে কেসিসি।

এ সম্পর্কিত আরও খবর