পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে খুন: যেভাবে ধামাচাপা দেওয়া হলো নির্মম হত্যাকাণ্ড

, জাতীয়

তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো | 2024-05-25 00:06:17

চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁওয়ের রূপালী আবাসিক এলাকায় ঢোকার মুখেই একটি সেলুন। সেই সেলুনে চুল কাটতে এসেছেন দোকানির পূর্ব পরিচিত গ্যারেজ মালিক সমীর ঘোষ। কথায় কথায় দোকানি সমীর ঘোষকে প্রশ্ন করেন তোমার গ্যারেজে কয়েকদিন আগে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে খুন করা কর্মচারীর পরিবার কি মামলা করেছে? সেই প্রশ্নের উত্তরে হাসতে হাসতে সমীর বলে ওঠেন, ‘মামলা হলে কি আমাকে এখানে দেখতি? জেলে কয়েকদিন থাকা হয়ে যেত এতদিনে।’

এরপর সমীর তুলে ধরেন কীভাবে ধামাচাপা দিলেন হত্যাকাণ্ড। বলেন, ‘আমার ছোট ভাই (চমেক হাসপাতালের সামনে দোকান করেন) হাসপাতাল ম্যানেজ করেছে। বাকিটা আমি ওই ছেলেটার বাড়িতে তিনবার গিয়ে টাকা পয়সা দিয়ে করেছি। পরে যাতে কোনো মামলা না করে সেজন্য ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্যের উপস্থিতিতে তার মা-ভাই থেকে লিখিতও নিয়েছি। আর কোনো ঝামেলা নেই।’ তখন সেলুনে চুল কাটতে আসা কয়েকজন সেটি শুনে কীভাবে ছেলেটাকে মেরে ফেলা হলো তা জানতে চান সমীরের কাছে। আশপাশের মানুষের আগ্রহ দেখে সমীর ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে যান, পরে দ্রুতই দোকান ত্যাগ করেন। ঘটানাক্রমে সেখানে ছিলেন এই প্রতিবেদকও।

সমীরের মুখ থেকে ঘটনার কিছুটা আঁচ পাওয়ার পর শুরু হলো বার্তা২৪.কমের অনুসন্ধান। দীর্ঘদিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো কীভাবে খুন করা হয়েছে এক তরুণকে। আর সেই হত্যাকাণ্ড কীভাবে দেওয়া হলো ধামাচাপা।

হত্যাকাণ্ডের শিকার তরুণটির নাম সুব্রত ঘোষ। আর তাকে খুন করেছেন সেও তরুণ, তার নাম মোহাম্মদ রকি। রকি আর সুব্রত কাজ করতেন চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল এলাকার দুটি গ্যারেজে। রকি এমরান হোসেনের গ্যারেজে আর সুব্রত সমীর ঘোষের গ্যারেজে। দুজনেই প্রায় সমবয়সী, ২৫-২৬ বছরের। ৫ মার্চ সন্ধ্যা ছয়টায় খুনের ঘটনাটি ঘটে এমরানের গ্যারেজে।

প্রথমে কথা কাটাকাটি। তারপর হাতাহাতি। সামান্য সেই বিষয় থেকেই জোর করে মোহাম্মদ রকি ব্লু পাইপের নজেল (চাকা পরিষ্কার ও বাতাস দেওয়ার যন্ত্র) ঢুকিয়ে দেন সুব্রত ঘোষের পায়ুপথে। মুহূর্তেই দাঁড়িয়ে থাকা সুব্রত নিথর হয়ে পড়ে যান নিচে। বাতাস ঢুকে ফুলে যায় তাঁর পুরো পেট। এরপর আশপাশের মানুষজন দ্রুত উদ্ধার করে সুব্রতকে নিয়ে যান স্থানীয় একটা ক্লিনিকে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রোপচার করিয়ে বের করা হয় বাতাস। কিন্তু এরপরই প্রয়োজন পড়ে আইসিইউর। সেজন্য নেওয়া হয় এক কিলোমিটার দূরের বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে। কিন্তু বাঁচানো যায়নি সুব্রতকে। স্বামীহারা মায়ের বেঁচে থাকার বড় অবলম্বন বড় ছেলেটি রাতেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।

বাড়ির দেয়ালে মা-বাবার সঙ্গে সুব্রত ও তার ছোট ভাইয়ের ছবি/ ছবি আনিসুজ্জামান দুলাল

জনাকীর্ণ এলাকায় ঘটে খুনের ঘটনাটি। পুরো ঘটনা দেখেছেন এমন সাক্ষীও আছেন। কিন্তু তারপরও হলো না কোনো হত্যা মামলা। সুব্রতের মা আর ভাইকে ভয় দেখিয়ে করতে দেওয়া হয়নি লাশের ময়নাতদন্তও। গভীর রাতে সুব্রতের মরদেহ পাঠিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের বাড়ি বাঁশখালীর পূর্ব চেঁচুরিয়া গ্রামে। ভোরের আলো কাটার আগেই নিজের বাড়ির আঙ্গিনায় সুব্রতের মরদেহ দাহ করার ব্যবস্থা করা হয়।

বাবা হারা সুব্রতের কাছে যিনি পিতৃতুল্য ছিলেন সেই গ্যারেজ মালিক সমীর ঘোষই আয়োজন করেন পুরো ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার। আর তাকে এই কাজে সহযোগিতা করেন বৈলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বিকাশ দত্ত। বার্তা২৪.কমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এক তরতাজা তরুণকে হত্যার পর কীভাবে ধামাচাপা দেওয়া হলো ঘটনা, কীভাবে ভয় দেখিয়ে ‍চুপ রাখা হলো তাঁর মা-ভাইকে।

সেদিন কি হয়েছিল

বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল লাগোয় মসজিদের আগেই একটি গলি চলে গেছে পশ্চিমে। সেই গলিতে একটু পা বাড়ালেই হাতের ডানপাশে এক তলা ভবন। ওই ভবনের নিচ তলায় দুই পাশে সারি সারি দোকান। একেবারে উত্তরে মুখোমুখি দুটি গাড়ির চাকা সংস্কারের গ্যারেজ। এর মধ্যে পূর্ব পাশের গ্যারেজটি সমীরের, এখানেই ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন সুব্রত। তার বিপরীতের গ্যারেজটি এমরানের। ঠিক কি হয়েছিল সেদিন, সেটি জানতে এই প্রতিবেদক তিনবার ঘটনাস্থলে গিয়েছেন। কিন্তু কেউ নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি।

তবে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী তুলে ধরেছেন পুরো ঘটনা। তারা বলেন, সেদিন ছিল মঙ্গলবার (৫ মার্চ) সন্ধ্যা। রকি ব্লু পাইপের নজেলের সাহায্যে চাকা পরিষ্কারের কাজ করছিলেন। সেটি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন সুব্রত। এমন সময় হঠাৎ কিছু বুঝে উঠার আগেই রকি নজেলটি সুব্রতের পায়ুপথ বরাবর চেপে ধরেন। সুব্রত প্যান্ট পরা থাকলেও উচ্চগতিতে বের হওয়া বাতাসের সামনে সেটি কোনো বাঁধা হলো না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পেট ফুলে নিস্তেজ হয়ে সুব্রত পড়ে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে রকিসহ আশপাশের গ্যারেজের কর্মীরা এসে সুব্রতকে পাশের একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে অক্সিজেন সরবরাহ মেশিন না থাকায় নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। চমেকে নেওয়ার পর অস্ত্রোপচার করে সুব্রতের পেট থেকে বাতাস বের করে আনা হয়। কিন্তু উচ্চগতির বাতাস ঢোকার কারনে সুব্রতর পাকস্থলি, যকৃত ও নাড়িভূড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেজন্য দ্রুত নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু চমেকে আইসিইউ খালি না থাকায় সুব্রতকে নিয়ে যাওয়া হয় এক কিলোমিটার দূরের বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে। সেখানে রাত ১২টা ১০ মিনিটে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন সুব্রত।

দুজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, কোনো কারণে সুব্রত ও রকির মধ্যে আগে থেকে মনোমালিন্য ছিল। সেই শোধ তুলতে চেয়েছিলেন রকি। গ্যারেজে মালিক না থাকার সুযোগে রকি নজেল লাগিয়ে দেন সুব্রতের পায়ুপথ বরাবর। কেননা দীর্ঘদিন ধরে গ্যারেজে কাজ করা রকি জানেন এই ব্লু পাইপের নজেলের উচ্চগতির বাতাস সরবরাহের বিষয়ে। এরকম ঘটনা তো দেশে বহুবার ঘটেছে। রকি না বুঝে এই কাজ করেছেন সেটি তাই মানা যায় না।

এই গ্যারেজেই সুব্রতকে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছে/ ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

সুব্রতের ভাইকে জানানো হয়নি শুরুতে

সুব্রতর ছোট ভাই সুমন ঘোষ আগে থেকে গ্যারেজে কাজ করেন। তিনিই সুব্রতকে সমীরের গ্যারেজে নিয়ে এসেছিলেন। আরেকটি গ্যারেজে কাজ করলেও সমীরের সঙ্গে তাই সুমনের ছিল ভালো সম্পর্ক। কিন্তু সুব্রত গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার পরও সুমনকে জানানো হয়নি ভাইয়ের এই দূরাবস্থার কথা। সুমন ঘটনাটি জানতে পারেন রাত আটটায়, সুব্রতকে চমেক হাসপাতালে নেওয়ার পর। সমীর সেটাও বাধ্য হয়েই জানিয়েছিল। কেননা, এমন স্পর্শকাতর রোগীকে অভিভাবক ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হচ্ছিল না।

সুব্রতের মা পান্না ঘোষ সেটিই তুলে ধরেন বার্তা২৪.কমের কাছে। বলেন, ‘রাত আটটার দিকে সুমনকে ফোন করে সুব্রতের বিষয়ে জানানো হয়। এরপর আমাকে ফোন করে ঘটনাটি জানায় সুমন। মূলত হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে অভিভাবকের প্রয়োজন পড়ে, সেজন্য সুমনকে ফোন করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।’

ঘটনা আড়াল করার চেষ্টায় সমীর

সুব্রত-হত্যা নিয়ে জানতে এই প্রতিবেদক তিনবার সমীরের গ্যারেজে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি। সাংবাদিক এসেছেন আঁচ পেয়েই কৌশলে সরে গিয়েছেন। ফোনে যোগাযোগ করা হলেও বারবার নানা সমস্যার কথা বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। অবশেষে গত মঙ্গলবার এই বিষয়ে কথা বলেন সমীর।

সমীর ঘোষ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি বাসায় ছিলাম। পরে জেনেছি রকি চাকা পরিষ্কারের কাজ করছিল আর সুব্রত দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপছিল। এমন সময় মশকারি থেকে হাতাহাতি হয় তাঁদের। পরে রকি নজেলটি সুব্রতের পায়ুপথে লাগিয়ে দেন। এর কিছুক্ষণ পরেই দাঁড়ানো থেকে নিচে পড়ে যান সুব্রত।’

চমেক হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন জানিয়ে সমীর বলেন, ‘সুব্রত আমার গ্যারেজে কাজ করতো। আমার আত্মীয়ও ছিল। তাই তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছি আমি। চমেক হাসপাতালে নিয়ে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করেছি। তবুও বাঁচাতে পারিনি।’

কোনো মামলা বা আইনি পদক্ষেপ নিলেন না কেন-এমন প্রশ্নে সমীর ঘোষ বলেন, ‘সুব্রত মারা যাওয়ার পর-পরই রকি পালিয়ে যায়। আমি নিজ উদ্যোগে সুব্রতের মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করেছি, সব খরচ দিয়েছি। পরে রকির বাবাকে ফোন করে এনেছি। সুব্রতের মা-ভাইয়ের সঙ্গে সমাঝোতা করিয়ে রকির বাবার থেকে দুই লাখ টাকা আদায় করে দিয়েছি। আর রকি ও তার বাবা সুব্রতের মা-ভাই থেকে মাফ চেয়েছে। যেহেতু টাকায় সমাঝোতা হয়েছে, মাফও চেয়েছেন সেজন্য ঘটনা আর বেশিদূর গড়ায়নি।’

এই নজেলটি দিয়েই সুব্রতের পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল/ ছবি: আনিসুজ্জামান দুলাল

হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়িতে খোঁজ নিয়ে সুব্রত সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি। সুব্রতের স্বজনদের ধারণা, সমীর ঘোষ পুলিশ পর্যন্ত যাতে ঘটনা না যায় সেই ব্যবস্থা করেছেন।

অন্যদিকে এমরানের গ্যারেজে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘সুব্রত যেদিন মারা গিয়েছেন সেদিনই রকিকে গ্যারেজ থেকে বের করে দিয়েছি। বলে দিয়েছি-আর না আসতে।’

রকির গ্রামের বাড়ি ঠিক কোন জায়গায় সেটি বলতে না পারলেও এমরান বলেছেন, নোয়াখালীতে জানি। তবে কোন উপজেলায় সেটা জানি না। শুনেছি এখন বাড়িতেই আছে রকি।’

তবে সুব্রত হত্যার পর থেকে রকি নিজের পুরনো মুঠোফোন নম্বরটি আর ব্যবহার করছেন না। তাঁর মুঠোফোনে গত এক সপ্তাহ ধরে বহুবার ফোন করা হলেও বারবার বন্ধ পাওয়া গেছে। তাঁর বাবার নম্বরও পাওয়া যায়নি, ফলে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

মায়ের চোখে আজও জল

চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে বাঁশখালী উপজেলার হাবিবের দোকান এলাকা। সেই বাজারের প্রায় সবাই জানেন সুব্রতের অন্তিম পরিণতির কথা। কীভাবে তাঁর মৃত্যু হলো সেটিও সবার জানা। সম্প্রীতি সেখানে গেলে তাঁরাই দেখিয়ে দেন সুব্রতের বাড়ি। হাবিবের দোকানের মাঝখান থেকে একটি সড়ক চলে গেছে সোজা পূর্বের দিকে। ইট-মাটির সেই সড়ক ধরে ১০ মিনিট গাড়ি চালালেই পাহাড়ি ছড়ার পাশে সুব্রতদের টিনের ঘর। সদ্য তোলা সেই বাড়ির সামনে থালা-বাসন পরিষ্কার করছিলেন পান্না ঘোষ।

পরিচয় দিয়ে সুব্রতের কথা তুলতেই এতদিন চাপা পড়ে থাকা কান্না যেন ফের ফিরে এল পান্না ঘোষের চোখে। বলেন, ছেলেকে তো হারিয়ে ফেলেছি এখন বলে কি হবে আর।

পরে ঘরের ভেতরে নিয়ে যান পান্না ঘোষ। সেখানে এরই মধ্যে হাজির হন সুব্রতের জেঠা বাবুল ঘোষসহ কয়েকজন নারী। বাড়ির টিনের দেয়ালে পেরেক ফুঁড়ে লাগানো হয়েছে বেশ কিছু পারিবারিক ছবি। সেই ছবিগুলোর মাঝখানে বড় করে বাঁধাই করে ঝোলানো সুব্রত ঘোষের ছবি। নিচে লেখা : ‘স্বর্গীয় সুব্রত ঘোষ। জন্ম: ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭, মৃত্যু ৫ মার্চ ২০২৪।’

সেই ছবিটা হাতে নিয়ে আবার কাঁদতে শুরু করেন পান্না ঘোষ। আর বলতে থাকেন, ‘১৯ বছর আগে ২০০৬ সালে স্বামী সুজল ঘোষকে আচমকা হারিয়েছিলাম। তখন ৭ ও ৫ বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে কি যে কষ্ট করেছি! মানুষের ঘরে ঘরে কাজ করে দুই ছেলেকে মানুষ করলাম। আজ দুই ছেলে চাকরি করে আমার কষ্ট অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছিল। এখন আমাকে আর মানুষের ঘরবাড়িতে গিয়ে কাজ করতে হয় না। দুই ছেলে বহু কষ্টে এই বাড়িটি তৈরি করেছে। কথা ছিল কিছুদিন পরেই সুব্রতকে বিয়ে করাব। এখন তো আমার ছেলেটাই হারিয়ে গেল। কোটি টাকা দিলেও তো ছেলেকে আর পাব না।’

সুব্রতের জেঠা বাবুল ঘোষও তখন কথা বলতে শুরু করেন। বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। ছোট ভাই মারা যাওয়ার পর তার দুই সন্তানকে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য ছিল না। তার মা বহু কষ্টে দুই ছেলেকে বড় করেছেন। এখন যখন সুখের সময় তখনই কিনা বড় ছেলেটা খুন হলো।’

ছেলে হারানোর সেই ভয়াল রাতের কথা তুলে ধরেন পান্না ঘোষ। বলেন, ‘আমাকে রাত ৮টায় ফোন করে সুমন জানায় সুব্রতের অবস্থা খারাপ। পরে তড়িঘড়ি করে আমি চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশে রওনা হই। রাত ১০টার দিকে চমেক হাসপাতালে পৌঁছাই। দেখি আমার ছেলের পেট কাটা। ছেলের সঙ্গে শেষ কথাও হলো না। এই দুঃখ সারাজীবন কীভাবে বয়ে বেড়াব।’

সমাঝোতার বিষয়ে জানতে চাইলে পান্না ঘোষ বলেন, ‘ছেলের লাশের বদলে আমি কোনো টাকা চাইনি। এখনো চাই না।’ কথা বলার সময় অবশ্য বারবার আতঙ্কিত দেখাচ্ছিল পান্না ঘোষকে। বড় ছেলেকে হারানো মায়ের ভয়-কথা বললে ছোট ছেলের কিছু হবে না তো?

সমাঝোতার সময় ঘটনাস্থলে থাকা দুজন ব্যক্তি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘কোনোভাবেই ছেলের লাশের বদলে টাকা নিতে চাননি পান্না ঘোষ। কিন্তু সমীর ও বিকাশ এক প্রকার চাপ প্রয়োগ করে টাকা ধরিয়ে দিয়ে সমঝোতা করতে বাধ্য করেন পান্না ও সুমনকে। সুমনকে নানা ভয় দেখানো হয় তখন। বড় ছেলেকে হারিয়ে শোকাস্তব্দ মা পান্না ঘোষ ছোট ছেলে সুমনের কিছু হবে ভেবে সমীর-বিকাশদের কথা মেনে নিয়েছেন।’

বৈলছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. কফিল উদ্দিনকে শুরুতে বিষয়টি জানানো হলেও সমাঝোতার সময় ডাকা হয়নি। কফিল উদ্দিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘সুব্রতকে হত্যার ঘটনায় আমার মাধ্যমে কোনো সমাঝোতা হয়নি। শুনেছি পারিবারিকভাবে সমাঝোতা হয়েছে। বৈঠকে ইউপি সদস্য বিকাশ দত্ত ও এলাকার বেশ কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন। সেখান থেকে আমাকে জানানো হয়-সুব্রতর মা নাকি বারবার বলছিলেন তাঁর কোনো টাকা দাবি নেই। সেটি শুনে আমি ওই মায়ের কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম সমঝোতা করার সময় যদি আমাকে দরকার পড়ে তাহলে আমি যাব। কিন্তু পরে আমাকে কোনো খবর দেওয়া হয়নি। ফলে আমি জানি না কত টাকায় সমাঝোতা হয়েছে।’

বিকাশ দত্তের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো অনেক আগের ঘটনা। সুব্রতের পরিবার আমাকে বিষয়টি জানার পর আমিসহ বসে সমাধান করে দিয়েছি। এটা তো ওইদিনই শেষ।’ তবে টাকা দিয়ে সমাঝোতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সেটি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘টেলিফোনে এত কথা বলা যাবে না। সামনাসামনি আসেন।’

যে গ্যারেজে সুব্রত খুন হয়েছেন সেখান থেকে আধাকিলোমিটার দূরেই চান্দগাঁও থানা। তবে ঘটনার প্রায় আড়াইমাস পার হলেও এই সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা নেই পুলিশের।

জানতে চাইলে চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের জানা নেই। কেউ অভিযোগও করেনি। তবে এখন যেহেতু জানলাম, এই বিষয়ে খোঁজ নেব।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘পুলিশের নিজস্ব সোর্স থাকে। তাদের কমিউনিটি পুলিশিংও আছে। এরপরও যদি এমন পাশবিক ও নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পুলিশ না জানে সেটা কী বিশ্বাসযোগ্য।’

চাপে চাকরি ছেড়েছেন সুমন

বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর স্বাভাবিক হয়ে চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল এলাকার গ্যারেজে কাজে যোগ দিয়েছিলেন সুমন। কিন্তু অনেকেই তাঁর কাছে গিয়ে ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চান। ফলে ঘটনাটি ছড়াতে থাকে। সুমনের ঘনিষ্ট দুজন ব্যক্তি জানান, ‘সুমন ভাইয়ের বিষয়টি সবাইকে বলাবলি করলে সমীর ঘোষসহ অন্যরা তাঁকে ভয় দেখান। বলেন, ‘‘টাকা নিলি, মামলা করবি না বলে লিখিত মুচলেকা দিলি-তারপরও কেন সবাইকে বলে বেড়াস।’’ এরপর আতঙ্কে চাকরি ছেড়ে দেন সুমন।’ অজানা আতঙ্কে ফোনও এড়িয়ে চলছেন এই তরুণ, তাই কথা বলা সম্ভব হয়নি।

সমীর ঘোষের কাছে সুমন সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘সে তো চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে গেছে।’ তবে চাপ দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন সমীর।

চার মাস আগে গ্যারেজে যোগ দেন সুব্রত

সুব্রত এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। তবে অকৃতকার্য হওয়ায় পড়াশোনা আর এগোয়নি। পরে হাবিবের দোকান এলাকার একটি ওষুধের ফার্মেসিতে চাকরি নেন সুব্রত। কিন্তু করোনার সময় সেই চাকরিও হারান। এরপর বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করেছেন। গ্যারেজে যোগ দেওয়ার আগে একটি মিষ্টির দোকানে কাজ করতেন। গত ডিসেম্বরে ছোট ভাই সুমন তাঁকে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে এসে ওই গ্যারেজে চাকরির ব্যবস্থা করেন। সেখানে ১৬ হাজার টাকা বেতন পেতেন সুব্রত। কিন্তু চাকরির চার মাসের মাথায় লাশ হয়ে ফিরতে হয় তাঁকে।

দুই ভাই শহরে, গ্রামে মা একা। সুমনকে ব্যস্ত থাকতে হতো প্রতিদিন। তাই বৃহস্পতিবার এলেই মায়ের কাছে ছুঁটে যেতেন সুব্রত। দুদিন মাকে সময় দিয়ে ফিরতেন শহরে। পান্না ঘোষ সেই স্মৃতিচারণ করে বললেন, ‘আর দুদিন পর হলেই ছেলে আমার কাছে আসতো। কিন্তু তার আগেই মঙ্গলবার চলে আসল। কিন্তু আমার সেই তরতাজা ছেলেটা নয় এলো তারই নিথর দেহ।’

পান্না ঘোষের কথায় একদিকে ছেলে হারানোর হাহাকার, অন্যদিকে যেন ছেলের খুনের বিচার পাওয়ার আকুতি!

এ সম্পর্কিত আরও খবর