পুলিশ-জনতা সংঘর্ষ: গ্রেফতার আতঙ্কে পুরুষ শূন্য চার গ্রাম

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, গাইবান্ধা | 2024-06-15 15:17:12

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে কোরবানির পশুর হাট বসানোকে কেন্দ্র করে পুলিশ-জনতার সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। মামলায় নামীয় ৩৩ জন ও অজ্ঞাতনামা ৭০ থেকে ৮০ জনসহ ১১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ওই মামলার ছয় অভিযুক্তকে। ফলে গ্রেফতার আতঙ্কে পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে উপজেলার চার গ্রাম। দুদিন বাদেই আনন্দের ঈদুল আজহা হলেও অবুঝ সন্তান নিয়ে নানা শঙ্কা ও আতঙ্কে দিন কাটছে ওইসব গ্রামের গৃহবধূদের।

গত বুধবার (১২ জুন) বিকেলে উপজেলার শান্তিরাম ইউনিয়নের মজুমদার বাজার সংলগ্ন জমিতে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের ঘটনায় চার পুলিশসহ অন্তত ১২ জন আহত হন। এ সময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিন রাউন্ড গুলিও বিনিময় করেছে পুলিশ। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করাসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। ওই সময় ঘটনায় একে অপরকে দোষারোপ করে ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য দেন হাটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতা, ইজারাদার ও পুলিশ।

ঘটনার দিন রাতেই (১২ জুন) ওই এলাকার ৩৩ জন নামীয় ও ৭০ থেকে ৮০ জন অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে দেওয়ার অভিযোগে সুন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলার পর ওই রাতেই উপজেলার শান্তিরাম এলাকার রুহুল আমিনের ছেলে রুবেল মিয়া (২৯), সতীরজান এলাকার লাল মিয়ার ছেলে মজিবুর রহমান (৫১) ও উত্তর ধর্মপুর এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে মামুন অর রশিদ (২৯)সহ তিন গ্রামের তিনজকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

পরদিন বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) রাতে গ্রেফতার করা হয় আরও তিনজনকে। পুলিশের এমন তৎপরতায় পুরুষ শূন্য হয়ে পড়েছে পাঁচগাছি শান্তিরাম, খামার ধুবনী, সতীরজান ও উত্তরধর্মপুরসহ চার গ্রাম। তারা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে রয়েছেন। বাড়িতে রয়েছে কেবল নারী-শিশু ও বৃদ্ধরা।

শান্তিরাম গ্রামের সত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধা রোকেয়া বেওয়া জানান, হাটের ঘটনায় প্রতিদিন রাতেই পুলিশ আসছে। এরমধ্যে তিন গ্রাম থেকে নাকি ছয়জনকে ধরেও নিয়ে গেছে। সেজন্য এই গ্রামে কোনো পুরুষ মানুষ নাই, সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কাল বাদে ঈদ। যাদের বাড়িতে পুরুষ নাই, তারা কেমনে ঈদ করবে?

হাট ইাজারাদার সংশ্লিষ্টদের দাবি, তারা সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এক বছরের জন্য মজুমদার হাটটি ইজারা নিয়েছেন। সেখানে কোরবানি ঈদ উপলক্ষে পশুর হাট বসানোর জন্য উপজেলা প্রশাসনের কাছে অনুমতি চায় তারা । অনুমতি না পেয়ে হাট বসানোর জন্য হাইকোর্টে আবেদন করলে গত ১১ জুন হাইকোর্টের আইনজীবী মো. নূরনবী উপজেলা প্রশাসন বরাবর একটি উকিল নোটিশ পাঠায়। যার প্রেক্ষিতে প্রশাসন তাদের মৌখিভাবে সেখানে পশুরহাট বসানোর নির্দেশ দেন বলেও দাবি তাদের।

তাদের অভিযোগ, হাট বসাতে সুন্দরগঞ্জ থানা পুলিশ তাদের কাছে ১ লাখ টাকা উৎকোচ দাবি করেন। পুলিশের দাবির প্রেক্ষিতে ইজারাদারের পক্ষ থেকে ৩০ হাজার টাকা দিতে রাজি হলেও পুলিশ সর্বশেষ ৫০ হাজার টাকা চেয়ে বসেন। পরে এ নিয়ে বারবার দেন-দরবারের এক পর্যায়ে গত বুধবার বিকেলে হঠাৎ পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে এবং পশুর হাট অবৈধভাবে বসানো হয়েছে জানিয়ে, বিভিন্ন মহলের অভিযোগের কথা তুলে ধরে হাট পণ্ড করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। পুলিশের এমন কাণ্ডের একপর্যায়ে হাটে থাকা উপস্থিত জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। এতে পুলিশ ক্রেতা এবং বিক্রেতাদের ছত্রভঙ্গ করতে তিন রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে। একপর্যায়ে ইজারাদারের লোকজন, হাটের ক্রেতা-বিক্রেতা, দালাল ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় নগদ প্রায় ৩০ লাখ টাকাসহ অন্তত ১৫ থেকে ২০টি গরু-ছাগল হারিয়ে গেছে।

পুলিশের দাবি, ‘৯৯৯’ নম্বরে বিভিন্ন মহলের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ সেখানে কোরবানির পশুরহাট না বসানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন। কিন্তু হাট ইজারাদার সংশ্লিষ্টরাসহ উপস্থিত জনতা পুলিশের সরকারি কাজে বাঁধা প্রদান করেন। তাদের আক্রমণে পুলিশের এসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই মাসুদ রানা, কনস্টেবল মনির হোসেন ও সোলায়মান হোসেন আহত হয়েছেন।

সুন্দরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহবুব আলম বলেন, মজুমদার হাটে সরকারি কাজে বাঁধা এবং পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় ওই দিন রাতেই ৩৩ জন নামীয় এবং ৭০ থেকে ৮০ জন অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলায় এখন পর্যন্ত এজাহার নামীয় ছয়জন আসামিকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এসময় হাট ইজারাদারের কাছে উৎকোচ চাওয়ার বিষয়টি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি।

এ বিষয়ে গাইবান্ধার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ-সার্কেল) ধ্রুব জ্যোতির্ময় গোপ মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, কেবল ঘটনার সাথে জড়িত অভিযুক্তদের গ্রেফতার করছে পুলিশ। কোনোভাবেই নিরপরাধ কোনো মানুষকেই হয়রানি করতে গ্রেফতার করা হবে না। যারা অপরাধ করেনি বাড়িতে থাকতে তাদের কোনও ভয় নেই।

এ ব্যাপারে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, মজুমদার হাটে পশুর হাট বসাতে অনুমতি চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় অনুমতি দেওয়া হয়নি।

পরে কেন মজুমদার হাটের ইজারাদার কোরবানির পশুর হাট বসাতে পারবেন না, সে মর্মে হাইকোর্ট থেকে একটি লিগ্যাল নোটিশ সুন্দরগঞ্জ ইউএনও বরাবর পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে বিষয়টি নিয়ে গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপির মতামতের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞ পিপি মহোদয়ের মতামত পেলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর