চট্টগ্রামে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস, অবৈধ সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন'র সিদ্ধান্ত

, জাতীয়

স্টাফ কসেরপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম | 2024-06-20 23:50:31

চট্টগ্রামের পাহাড় ধসের শঙ্কা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরাতে পাহাড়ে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের যেসব অবৈধ সংযোগ রয়েছে সবগুলো বিচ্ছিন্ন করে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম।

বৃহস্পতিবার (২০ জুন) বিকেল তিনটার দিকে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৮তম সভার সিদ্ধান্তের কথা জানাতে গিয়ে তিনি এ নির্দেশনা দেন।

সভার সিদ্ধান্তের কথা জানাতে গিয়ে বিভাগী কমিশনার তোফায়েল ইসলাম বলেন, যেসব দপ্তর-সংস্থার মালিকানাধীন পাহাড়গুলোতে অবৈধভাবে মানুষ বসবাস করছে তাদেরকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা দপ্তরগুলোর প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি। এবং অবৈধভাবে বসবাসকারীদের মধ্যে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহর যে লাইনগুলো রয়েছে সেগুলো বিচ্ছিন্ন করে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এই কমিটি বরাবর এটির প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। তাছাড়া পাহাড়ের পাদ দেশে দেয়াল ধসের ঘটনা ঘটে। তাই সেখান থেকে যাতে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়া হয়।

এসময় ‌সারা বছর না উচ্ছেদ করে শুধু বর্ষা আসলেই কেন এই উচ্ছেদ কার্যক্রম করা হয়- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তোফায়েল ইসলাম বলেন, আমরা তো বলেছি কার্যক্রম সারা বছর ধরে চলমান আছে। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণের প্রশ্নটা আসে বৃষ্টি হলে।

এর আগে বিকেল তিনটা থেকে শুরু হওয়া এই সভায়টি প্রায় একঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে। সভায় পাহাড় ব্যবস্থা কমিটির সদস্যরাসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা তাদের বক্তব্য তুলে ধরেন।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৫ হাজার ৩০০টি অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। এসব সংযোগ দিয়ে পাহাড়ে ঝুকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।

সভায় পাহাড়ে অবৈধ কোনো পানির সংযোগ নেই বলে দাবি করেন চট্টগ্রাম ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী সজীব বড়ুয়া। তিনি বলেন, আমরা পাহাড়ে কোনো পানির সংযোগ দেয়নি। যদি কোনো কারণে কোন সংযোগ দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে আমরা সেটি বিচ্ছিন্ন করবো। পাহাড় ব্যবস্থা কমিটির পাঠানো চিঠির প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম ওয়াসা একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাহাড়ের কোথাও ডিপ টিউবওয়েল আছে কিনা সেটি আগামী ১০ দিনের মধ্যে কমিটি আমাদেরকে প্রতিবেদন জমা দিবে। তারপর আমরা আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অভিযান করব।

সভায় পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে তাদের অভিযান চলমান আছি দাবি করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের অবৈধ পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান সবসময় চলমান আছে। শহরে খুলশী আর বায়েজিদ এই দুই এলাকায় পাহাড় কাটার ঘটনাটা বেশি। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে আমাদের ২০২৩ সালে মামলা হয়েছে ১৭টি। চলতি বছরেও এখন পর্যন্ত সাতটি মামলা হয়েছে এবং ২২ লাখ টাকা পরিমাণ জরিমানা করা হয়েছে।

শুধু মামলা হচ্ছে শাস্তির হচ্ছে না কেন- বিভাগীয় কমিশনারের এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, শাস্তি আছে স্যার, এ কাজের মধ্যে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তাদেরও সহযোগিতা আছে।

সভায় পাহাড়কে রক্ষার জন্য গোড়ায় হাত দিয়ে বিভাগীয় কমিশনারকে পরামর্শ দেন চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলের সভাপতি সভাপতি সাংবাদিক চৌধুরী ফরিদ। তিনি বলেন, আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে জানতে চাই, অনেকগুলা মামলা হয়েছে তবে এর মধ্যে কয়েক জনের শাস্তি হয়েছে। এ পর্যন্ত আমার রিপোর্টে ৭৪টি পাহাড় আপনার এলাকায় কাটা হয়েছে। পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরে মামলা হয় এই পর্যন্ত কয়জন আসামির বিরুদ্ধে শাস্তি হয়েছে। আমি আপনার মাধ্যমে উনার কাছ থেকে জানতে চাই। আর যে সমস্ত মামলা হয় সেগুলোর মধ্যে মালিককে মামলার আসামি করা হয় না, করা হয় শ্রমিক বা অন্যান্যদেরকে।

এসময় তিনি পাহাড় যারা কাটে তাদের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন সাজা হয় এমন আইন করার দাবি জানান। পাহাড় রক্ষা কমিটির এই সদস্য বলেন, যে পাহাড় কাটে তার বিরুদ্ধে দুই থেকে তিনটা মামলা হলে বিগত মামলাগুলোর কোন রেফারেন্স দেওয়া হয় না চার্জশিটের মধ্যে। আদালত একটা মামলা দিয়ে তাকে জামিন দিয়ে দিচ্ছে অথবা তার শাস্তি হচ্ছে না। এখানে সবাই আছে, আমি আপনার মাধ্যমে যারা পাহাড় কাটে তাদের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। এটি আপনি মাননীয় মন্ত্রীর মাধ্যমে জানান আমার দাবিটা। এটি আজকে প্রস্তাব করে আমাদের মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় পাঠানো হোক।

পাহাড় কাটার কারণে আজকে পাহাড় ধস হচ্ছে। পাহাড় কাটলে বা বৃষ্টি হলে আমাদের জেলা প্রশাসক মহোদয় সহ অন্যান্যদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। এসব কেন হচ্ছে, আমাদের সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। আমার মনে হয় আমাদের গোড়ায় গলদ। গোড়ায় আমাদের ঠিক করতে হবে। পাহাড়ের দুর্যোগের সময় রাতেও আমরা গিয়ে দেখেছি বিদ্যুৎ রয়েছে, ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সেখানে পানির লাইন নেই. কিন্তু আমরা সুন্দর পানির লাইন দেখেছি। আরেকটা বিষয় হচ্ছে যে পাহাড়গুলোতে দেখি সুন্দর রাস্তাও করে দেওয়া হয়েছে।

এসময় বিভাগীয় কমিশনার কারা করছে জানতে চাইলে চৌধুরী ফরিদ বলেন, এটাই তো, আপনি গোড়ায় আসেন। আমরা যাতায়াতের জন্য সুন্দর সুন্দর রাস্তা ব্যবস্থা করে দেব, পানির ব্যবস্থা করে দেব, বিদ্যুৎ লাইন দেব! এদেরকে চিহ্নিত করা দরকার এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

বিভাগীয় কমিশনার বলেন, অবৈধ পাহাড়ে কেন বৈধ রাস্তা হবে আমরা এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনকে অনুরোধ জানাবো।

বিভাগী কমিশনার তোফায়েল ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় চট্টগ্রাম ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগ, কর্ণফুলী গ্যাস ডিসট্রিভিউশন লিমিটেড, রেলওয়ে, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ অধিদপ্তর, সওজ, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিধিও পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

সভা শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখী হন জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান।

তিনি বলেন, গত এক বছরে চট্টগ্রাম নগরের মোট ২৬টি পাহাড় রয়েছে, আমরা সেই পাহাড়গুলোতে সাইনবোর্ড স্থাপন করেছি, যেন কোনভাবে কেউ পাহাড় না কাটে। এবং সেখানে আমাদের সহকারি কমিশনারদের (ভূমি) মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে। যাতে করে স্থানীয়রা আমাদের জানাতে পারে। কিন্তু এরপরও বিভিন্ন সময় দেখা যায় পাহাড় কাটা হচ্ছে। আমরা ধারণা করছি আগামী তিনদিন যদি ভারি বর্ষণ হয় তাহলে ভূমিধসের একটি আশঙ্কা রয়েছে। সে আশঙ্কা থেকেই আজকের এই সভাটি করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় বলা হয়েছে যে এই পাহাড়গুলোতে যারা অবৈধভাবে বসবাস করছেন তারা যেন ছেড়ে চলে যান। এই পাহাড়গুলোর মধ্যে কিছু ব্যক্তি মালিকানাধীন আর কিছু বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থার রয়েছে। আমরা সেই সকল দপ্তর-সংস্থাকে অনুরোধ করেছি তাদের পাহাড়ের যে সকল অবৈধ বসবাসকারীরা রয়েছে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়। প্রয়োজনে আমাদেরকে তালিকা দিয়ে উচ্ছেদ করার কথা বলা হলে আমরা নির্বাহীদের দিয়ে সেটি উচ্ছেদ করব।

তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন গত এক বছরে খাস খতিয়ানভুক্ত ১০ একর জায়গা উদ্ধার করেছে। সেই ১০ একর জমি উদ্ধারের পাশাপাশি বেশ কিছু ঘরও উচ্ছেদ করা হয়েছে। গত এক বছরে ৫টি উচ্ছেদ অভিযান আমরা করেছি। ১১টির বেশি পরবিারকে উচ্ছেদ করেছি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু দপ্তর সংস্থার পাহাড় রয়েছে যেগুলোতে আমরা অভিযান চালাতে পারি না। এসব পাহাড়ে রাস্তা করা হচ্ছে, পাহাড় কেটে বাড়ি বানানো হচ্ছে, ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। এখানে অনেকেই সম্পৃক্ত রয়েছে এবং তাদের মধ্যে দু-একজন বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করেছে। এর বাইরে দু-একজন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে যখন আমরা অভিযোগ পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা তাদেরকে শোকজ করেছি। তাদেরকে
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা উপরে বলেছি, তাদেরকে বরখাস্ত করা হয়েছে। পরে তারা মহামান্য হাইকোর্ট থেকে একটি আদেশ এনে পুনরায় দায়িত্ব পালন করতেছেন।

ডিসি বলেন, আজকে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাসের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য বলা হয়েছে। আমরা আশা করি, যারা পাহাড়ে অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন তারা সেখান থেকে যাতে নিরাপদ আশ্রয়ে আসেন। আমরা আমাদের অভিযান চালাচ্ছি এবং আমরা অন্যান্য দপ্তর-সংস্থাকে বলব তারা যেন তাদের পাহাড়গুলোকে সংরক্ষণ করেন।

উচ্ছেদে বাধা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আপনারা দেখেছেন বাধা বলতে এখানে অনেকগুলো মানুষ বসবাস করে, প্রায় ২০ হাজার। এখান থেকে বিপুল জনগোষ্ঠীকে সরিয়ে আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে আইন-শৃঙ্খলা অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যে পাহাড়গুলোর মালিকানা বিভিন্ন দপ্তর সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ের কাছে দিয়েছে তারা যদি উচ্ছেদ করার পর এগুলোকে সংরক্ষণ করে রাখেন বা সীমানা প্রাচীর দিয়ে রাখেন, তাহলে নতুন করে সেখানে আর কেউ স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না। এসব না করার কারণে দেখা যায়, আমরা নামিয়ে নিয়ে আসছি আবার কিন্তু তারা উঠে যাচ্ছে। এটি দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না, আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত না পাহাড়ে যারা মালিক তারা সচেতন হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবো না।

এ সম্পর্কিত আরও খবর