আমি ওষুধ কিনলে সন্তানের মুখে ভাত জোটে না

ময়মনসিংহ, জাতীয়

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ), বার্তা২৪.কম  | 2023-08-19 11:04:58

‘কানে টিউমার অইছিল। অনেক কষ্টে ১৫ হাজার টেকা দিয়া অপারেশন করছিলাম। অহন প্রতি হপ্তায় ৭৫০ টেকার ওষুধ লাগে। আমি গরিব মানুষ, চানাচুর বেইচ্যা খাই। ঘরে আমার দুইডা ছোট সন্তান। কিন্তু নিজের ওষুধ কিনলে, দুই সন্তানের মুখে ভাত জোটে না। ওরা না খাইয়্যা থাহে।’

এ কথাগুলো গৌরীপুর রেলওয়ে স্টেশনের ভ্রাম্যমাণ চানাচুর বিক্রেতা আবুল হোসেনের (৩৫)। তিনি গৌরীপুর পৌর শহরের চকপাড়া মহল্লার মৃত ফজর আলীর ছেলে।

গতকাল মঙ্গলবার (২৯ জানুয়ারি) দুপুরে আবুল হোসেনের দেখা মিলে গৌরীপুর রেলওয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে। চানাচুরের ডালা নিয়ে ধীর গতিতে তিনি হেঁটে চলছেন যাত্রাবিরতি করা আন্তনগর বিজয় এক্সপ্রেস ট্রেনের পাশ দিয়ে। চোখে-মুখে তার ক্লান্তির ছাপ। ইশারায় ডাক দিতেই আবুল বলেন, ‘মামা মাথার মধ্যে কিমুন জানি চক্কর মারতাছে, অহন বেচাকিনা করুম না। আগে একটু জিরাইয়া (বিশ্রাম) লই।’

স্টেশনের একটি দোকানের বেঞ্চে বসে বিশ্রামের পর কিছুটা স্বাভাবিক হন আবুল। কথাবার্তায় ফিরে আসে তার প্রাণচাঞ্চল্য। তেল, লবণ, চানাচুর, পেঁয়াজ, মরিচের মিশ্রণ কৌটায় ভরে হাতের ঝাঁকুনিতে মজাদার চানাচুর তৈরি করেন আবুল। সেই চানাচুর খেতে খেতেই আবুলের সঙ্গে গল্প জমে উঠে।

আবুল বলেন, ‘অভাবের কারণে ছোড থেইক্যাই ইস্টিশনের টেরেইনে চানাচুর বেইচ্যা সংসার চালাইতাম। বড় অইয়্যা ঘরে বউ কইর‌্যা আনি জারিয়া এলাকার মেয়ে আনেসারে। ঘরে আহে দুই পোলা-মাইয়্যা রনি ও আসমা। অভাবের মইধ্যেও সংসারডা ভালাই চলতাছিন। এর মইধ্যে হুট কইর‌্যা আমার বউডা পাগল হইয়্যা গেল। চিকিৎসাতেও কোনো কাম অইলো না। শ্বশুরবাড়ির লোকজন সন্তান দুইডারে রাইখ্যা বউডারে নিয়া গেল। এর মইধ্যে কয়েক মাস আগে আমার কানে টিউমার অপারেশন অইছে। ডাক্তার কইছে রেস্টে থাকতে। কিন্তু রেস্টে থাকলে তো আমার সন্তান দুইডা না খাইয়্যা থাকবো। তাই অসুইখ্যা শইল নিয়া ইস্টিশনে আইছি।’

আবুলের দুই সন্তান স্থানীয় একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। তাদের দেখাশোনা করে আবুলের মা হাসনা বেগম। কিন্তু সংসার চলে আবুলের চানাচুর বিক্রির টাকায়। প্রতিদিন সকালে গৌরীপুর স্টেশনে এসে ট্রেনে ঘুরে ঘুরে চানাচুর বিক্রি করেন আবুল। এতে তার আয় হয় ২ থেকে ৩শ টাকা। সেটা দিয়েই নিজের ওষুধ, সন্তানদের পড়াশোনা ও সংসার চালান তিনি।

কথা প্রসঙ্গে আবুল জানান, অপারেশনের পর ডাক্তার কিছু শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পুনরায় দেখা করার কথা বলেছিল তাকে। কিন্তু টাকার জন্য সেটা করতে পারেননি আবুল। এখন হাঁটলে তার মাথা ঘুরায়, শরীর ব্যথা করে, ভারী কোনো কাজ করতে পারেন না। চিকিৎসার জন্য অনেকের কাছে হাত পাতলেও কেউ তাকে সাহায্য করেনি। কিন্তু এসব নিয়ে আবুলের দুঃখ নেই। তার দুঃখ শুধু স্ত্রী সন্তানদের জন্য। অভাবের কারণে তিনি স্ত্রীর ভালো চিকিৎসা করাতে পারেননি। সন্তানদের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিতে পারছেন না। এসব কথা মনে হলেই তার চোখ ভিজে আসে।

আবুল হোসেন বলেন, ‘চিকিৎসার অভাবে বউডা ধুইক্যা মরতাছে। সন্তান দুইডা ছিঁড়া কাপড় পইর‌্যা ইশকুলে যায়। কতদিন ধইর‌্যা কইতাছে আব্বা পোলাও, মাংস খামু। কিন্তু টেকার অভাবে হেই খাওন খাওয়াইতে পারি না।’

এরই মাঝে হুইসেল বাজিয়ে স্টেশনে এসে যাত্রাবিরতি করে ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা মোহনগঞ্জগামী লোকাল একটি ট্রেন। এমন সময় গল্পে যোগ দেয় স্থানীয় বাসিন্দা মিলন খান। আবুলকে বসে থাকতে দেখে মিলন বলেন, ‘আরে আবুল ভাই, বিজয় ট্রেন গেছেগা, তুমি অহনো ইস্টিশনে বইয়া আছো।’

কথার রেশ টেনে আবুল বলেন, ‘আইজগা ঠান্ডা বাতাস পড়ছে, বেচাকিনা কম। কয়ডা টেকা কামাই না করলে বাড়িত চাইল-ডাইল নিমু কেমনে? হেরলেইগ্যা ইস্টিশনে বইয়্যা রইছি।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর