নেতৃত্ব সংকটে রংপুরে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল আ.লীগ

, জাতীয়

আমিনুল ইসলাম জুয়েল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, রংপুর | 2024-07-30 16:59:02

রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ভরা ডুবির পর দলীয় ব্যর্থতার দায়ে এক বছর আগে জেলা ও মহানগর কমিটি ভেঙে দিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু আহ্বায়ক ও মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগসহ তৃণমূলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে অনেক নেতাকর্মী মনে করছেন। যা নিয়ে নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

নেতাকর্মীরা বলছেন, অসন্তোষ, নেতৃত্ব সংকট ও সমন্বয়হীনতার কারণে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে দলটি। সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারায় যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

বিশেষ করে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন ও লুটপাটের ঘটনার পর শীর্ষ নেতারা দেখতে না আসায় ক্ষোভে ফুঁসছেন তারা।

গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) বিকেল ৪ টার দিকে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে শুরু হয় তাণ্ডব ও নাশকতা। ভাঙচুর করে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় রংপুর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয়েও।

একইসঙ্গে রংপুর নগরীর তাজহাট থানা, উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়, জেলা ছাত্রলীগ ও মহানগর শ্রমিকলীগ কার্যালয় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। নগরীর জাহাজকোম্পানি মোড়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বেশ কয়েকটি যানবাহন।

এছাড়াও শুক্রবার (১৯ জুলাই) নগরীর আরও বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তাণ্ডব চালানো হয়। এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ঢাকা ব্যাংকের বুথ ভাঙচুর ও লুট, জেলা ছাত্রলীগের কার্যালয় ভাঙচুর ও লুট, মহানগর জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যালয় ভাঙচুর, জেলা পরিষদ কমিউনিটি সেন্টার মার্কেট ভাঙচুর, নগরীর রোড ডিভাইডার ভাঙচুর, সিটি করপোরেশনের ১২৪টি সিসি ক্যামেরা ভাঙচুর, বঙ্গবন্ধু চত্বর ভাঙচুরসহ রেলগেট ভাঙচুর করা হয়েছে।

রংপুর নগরীতে শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকাল থেকেই ছিল না কোনো উত্তাপ। ওইদিন সরকারি ছুটি থাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ঘোষিত কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচিতে সুনশান ছিল পুরো নগর। আগের দিনের (বৃহস্পতিবার) তাণ্ডবের ক্ষতচিহ্ন রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নজর কাড়ে সাধারণ মানুষের। এরই মধ্যে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর শান্ত রংপুর ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রংপুর জিলা স্কুল মোড়, সিটি পার্ক মার্কেট চত্বর, পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানী মোড়, বিএনপির কার্যালয় সংলগ্ন গ্রাণ্ড হোটল মোড়, শাপলা চত্বর, পুরাতন ট্রাক স্ট্যান্ড, কলেজ রোড চারতলার মোড়, লালবাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পার্ক মোড়, মডার্ণ মোড়, দর্শনা মোড়, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকা ও ধাপ চেকপোস্ট এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে খণ্ড খণ্ড মিছিল বের হয়।

এসব মিছিলে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মী, সমর্থকরা ছাড়াও দুর্বৃত্তরা অংশ নেয়। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে গ্রাণ্ড হোটেল মোড় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। সেই মিছিল থেকে বেশ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের সাইনবোর্ডে ইটপাকটেল ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এ সময় সমবায় মার্কেট, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, ঢাকা ব্যাংকের বুথে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর চালানো হয়।

বৃহস্পতিবার বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবার আগেই কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় নগরীর আকাশ। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর ও আসবাবপত্রে আগুন দেয় হামলাকারীরা। নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের তাণ্ডবে বাদ পড়েনি সদর হাসপাতাল সংলগ্ন পরিবার পরিকল্পনার কার্যালয়। মা ও শিশুদের জন্য নির্মিত এই সরকারি সেবাপ্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়াসহ বেশ কয়েকটি যানবাহন আগুন দেন তারা।

এসব ঘটনার পরেও দলীয় নেতাকর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যবস্থা কিংবা এগিয়ে আসেনি। ফলে ফ্রি স্টালে চলে এসব তাণ্ডব। দলের ক্ষুব্ধ কর্মী-সমর্থকরা বলেন, যারা গর্তে লুকিয়ে আছেন, আশা করবো তারা সেখানেই থাকবেন। পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো হওয়ার পর মাঠে নামলে তাদের লজ্জিত হতে হবে।

এদিকে ঘটনার সাত দিন পরে দলীয় কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মামলা করেন জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। দেরিতে মামলা করায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। মহানগরে মামলা করেন দলের যুগ্ম আহবায়ক আবুল কাশেম এবং জেলার পক্ষে মামলা করেন আওয়ামী লীগ নেতা জিন্নাত হোসেন লাভলু। মহানগরে ৭১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত কয়েকশ জনকে আসামি করা হয়। আর জেলায় ৬৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত কয়েকশ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ঘটনার সাত দিন পরও মামলা না হওয়ার বিষয়টি নিয়ে দলের অনেকের মন্তব্য জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ নিজেদের কোন্দলে জর্জরিত। তাই নেতারা বাদী হওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন।

তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দাবি, বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে দলটি। একইসঙ্গে নেতৃত্ব সংকটও রয়েছে।

নেতাকর্মীরা বলেন, মহানগরসহ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে শীর্ষ নেতারা লুকিয়ে ছিল। আন্দোলনের সময় মহানগর আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ায় আমাদের অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) রংপুরে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও বিভিন্ন স্থাপনা দেখতে এসে আওয়ামী লীগের অবস্থান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

তিনি বলেছেন, রংপুরে আওয়ামী লীগের নেতারা ফেল করেছেন, তারা ঘুরে দাঁড়ালেই দুর্বৃত্তরা নাশকতা করতে পারত না। তিনি বলেন, কোটা সংস্কারের নামে সারা দেশে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে, তা দেশের মানুষ দেখেছেন। সেই নৃশংসতা থেকে রংপুরও বাদ যায়নি। কিন্তু রংপুরে আওয়ামী লীগের দুর্বলতা রয়েছে, নেতারা ফেল করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, শীর্ষ নেতারা জানতো দলীয় কার্যালয়ে হামলা হতে পারে। কিন্তু তারা কর্মীদের নিয়ে দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান না নিয়ে কৌশলে পার্টি অফিস ত্যাগ করেছে।

রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সাফিয়ার রহমান বলেন, ক্ষমতার সুবিধা নিয়ে যারা দেশের এমন ক্রান্তি লগ্নে ঘুমিয়ে আছেন এবং বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করছেন তাদের চিহ্নিত করার সময় এসেছে। দলের সাংগঠনিক ভিত্তিকে গোছানো ও মজবুত করতে না পারলে সামনে এর চেয়েও বেশি ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাড. আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন এসে এ তাণ্ডব চালিয়েছে। আর আমাদের উপজেলার নেতাকর্মীরা স্ব স্ব উপজেলায় অবস্থান নিয়েছিল। তবে আমরা সেদিন দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নিলে নাশকতাকারীরা এ তাণ্ডব চালাতে পারতো না।

রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল কাশেম বলেন, বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে আমরা দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান নিয়েছিলাম। আমরা চলে আসার পরপরই হামলা হয়েছে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর