বাস্তুহারারা এখন নিজ জমিতে

ঢাকা, জাতীয়

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-26 12:33:01

বরগুনা থেকে: এতোদিন ছিলেন বাস্তুহারা, এখন নিজেদের নামে একখণ্ড করে জমি কিনে মাথা গোঁজার ঠাঁই গড়েছেন। দীর্ঘ সময়ের বসতি ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট এখন তাদের আনন্দে রূপান্তরিত হয়েছে।

বাঁধের পরিত্যক্ত জমিতে ঘর থাকলেও সবসময় আতঙ্কে দিনাতিপাত করতে হতো, না জানি কখন উচ্ছেদের নোটিশ আসে। যে কারণে অনেকের সামর্থ্য থাকলেও কুঁড়েঘরে মানবেতর জীবনযাপন করতো পরিবারগুলো। সেই পরিবারগুলো কমবেশি সকলেই একখণ্ড করে জমি কিনেছেন। যাতে কেউ আর ভূমিহীন বা বাস্তুহারা বলতে না পারে। প্রথমদিকে তারা কিছুটা বিভ্রান্ত ছিলেন। কিন্তু এখন নগদ টাকা পেয়ে অনেক খুশি।

তালতলীতে নির্মাণাধীন বরিশাল ৩০৭ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এমন অভিব্যক্তি পাওয়া গেছে। পায়রা নদীর মোহনায় নির্মাণাধীন এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জায়গায় কোনো স্থায়ী বসতি ছিল না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়ি বাঁধে ঘর তুলে বসবাস করে আসছিলেন ৯৭টি পরিবার। যাদের কারোরই ছিলো না জমির বৈধ কোনো কাগজ।

মো. হানিফ ছিলেন তেমনি একজন বাস্তুহারা। থাকতেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের পাশে একটি টিনের ঘর তুলে। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, আমাদের এমনিতেই তুলে দিলেও কিছুই করার ছিল না। কারণ এই জমিতে আমাদের কোনো বৈধ দাবি নেই। কিন্তু প্রজেক্টের পক্ষ থেকে আমাকে দেড় লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এই টাকা দিয়ে জমি কিনেছি। সেখানেই ঘর সরিয়ে নিয়েছি। এখন আর আমাদেক আতঙ্কে থাকতে হবে না। এখন আর কেউ চাইলেও আমাদের উচ্ছেদ করতে পারবে না। আমি নিজের জমিতে থাকি।

বাস্তুহারারা নিজেদের জায়গায় গড়ছে বাড়িঘর, ছবি: বার্তা২৪.কম

আব্দুর রহমান নামের আরেকজন বলেন, নিজের জমি নেই বলে আমাদের সঙ্গে অনেকে আত্মীয়তা করতে চাইতো না। এখন নিজের জমিতে চলে যাবো। আমাদের সন্তানদের কেউ ভূমিহীন বলতে পারবে না। এটা যে কি পরিমাণ আনন্দের বিষয়- তা বলে বোঝাতে পারবো না।

তবে এখনও কয়েকটি পরিবার রয়ে গেছে। ঘরে থেকেই দরাদরি করে যাচ্ছে। তারা চান তাদের টাকার পরিমাণটা একটু বাড়িয়ে আদায় করতে। আবার আরেক শ্রেণি রয়েছে যারা তাদের উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান আইসোটেক গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক শরীফ হোসেন বার্তা২৪.কমকে বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ইস্যুতে সামনে চলে আসে উচ্ছেদ প্রসঙ্গ। তখন আমরা সম্পূর্ণ মানবিক কারণে কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের পুর্নবাসনের উদ্যোগ নেই। তাদের জন্য বাড়ি করে দেওয়া প্রস্তাব দেওয়া হয়। কারণ আমরা চাই না তারা কোনো কষ্ট পাক।

তখন ভূমিহীন এই জেলে পরিবারগুলো ঘরের পরিবর্তে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করে। যাতে তারা নিজের সুবিধামতো জায়গায় বসতি গড়তে পারে। তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অন্যান্য জায়গার মতো একটি মহল এখানেও রাতারাতি কিছু ঘর তুলে বসেন ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায়।

প্রথম সার্ভেতে দেখা যায় সেখানে ৯৭ পরিবার ছিলো। গত ডিসেম্বরে এসে দেখা যায় ১৩৯ পরিবার। জেলা প্রশাসকের সহায়তায় টাকা দিতে গিয়ে দেখা যায় আরেক ঘটনা। ছেলের বারান্দায় আশ্রিত বাবা নিজেও আলাদা বাড়ির টাকা দাবি করে বসেছেন। আবার বাবার একান্নবর্তী ছেলেও ঘরের টাকা চেয়ে বসে। একটি ঘরের জন্য তিন জনকে টাকা দিতে হয়েছে এমন রেকর্ড আছে বলে জানান শরীফ হোসেন।

এসব ক্ষেত্রে পরিবারের কর্তাকে দেড় লাখ অন্যদের কাউকে এক লাখ, কাউকে ৭৫ হাজার কাউকে ৫০ হাজার দিয়ে ফয়সালা করা হয়েছে। তবে এখন ১৮টি পরিবার বাড়ি সরিয়ে নেয়নি। এমনি একজন রাবেয়া বেগম। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘প্রজেক্টে নাকি টাকা আইছে ৭ লাখ টাকা করে। আমাদের কম দেচ্ছে। আমরা ন্যায্যমূল্য চাই।’ কিন্তু জমিতো আপনার নয়, কি জন্য টাকা চাচ্ছেন? ‘সবাইরেতো টাকা দেচে আমাদেক দেচ্চে না’- তার উত্তর।

তাদের কথায় প্রমাণিত কেউ তাদের পেছন থেকে ইন্ধন যোগাচ্ছে এই বলে যে তাদের নামে অনেক টাকা বরাদ্দ এসেছে। অথচ তাদের টাকা দেওয়া হচ্ছে পেঅর্ডারের মাধ্যমে। যাতে ভুলবুঝাবুঝির কোনো সুযোগ না থাকে।

প্রকল্প এলাকায় এখনও কিছু বাড়িঘর রয়ে গেছে, ছবি: বার্তা২৪.কম

শরীফ হোসেন বলেন, আমরা চাই না একটা লোকও কষ্ট পাক। তাদের কাগজ আছে না নাই সেটা আমাদের কাছে বড় বিষয় না। আমাদের কাছে বড় বিষয় তাদের পুনর্বাসন। কিন্তু কেউ যদি জিম্মি করতে চায় তখন সেটা কষ্টের। আমরা আশা করছি খুব শিগগিরই বাকিরা টাকা নিয়ে চলে যাবেন। আমাদের এখান থেকে যারা চলে গেছে তাদের বাড়ি যাতায়াতের রাস্তাও আমরা করে দিয়েছি। বরিশাল পাওয়ার কোম্পানি একটি মানবিক কোম্পানি হিসেবে মানুষের মনে ঠাঁই করে নিতে চায়।

এ সম্পর্কিত আরও খবর