ঘনিয়ে আসছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পীরা। দেবী দুর্গা, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিককে আকৃতি দিতে রাত দিন পরিশ্রম করছেন তারা। দম ফেলারও যেন ফুসরত নেই তাদের।
শুক্রবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর রমনা কালী মন্দির ও ঢাকেশ্বরী মন্দির ঘুরে নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বললে এসব তথ্য জানা যায়।
সরেজমিনে রমনা মন্দির ঘুরে দেখা গেছে, গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই মন্দিরের সামনে দেখা মেলে কাঁদা মাটির আস্তরন দিয়ে রেখে দেয়া হয়েছে নির্মিত দূর্গা প্রতিমা। মূলত দ্বিতীয় পর্বের কাজ দোমেটে শেষে প্রতিমা শুকাতেই এখানে রাখা হয়েছে। এরপর সামনে এগিয়ে গিয়ে মন্দিরের পেছনের দিকে যেতেই দেখা মেলে সারিবদ্ধ ভাবে রাখা হয়েছে প্রতিমা। এদিকে প্রতিমা শ্রমিকেরা এক মনে কাজ করে চলেছেন। দম ফেলারও যেন ফুসরত নেই তাদের। কেউ কেউ কাঁদা মাটির উপরে আকৃতি ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত, কেউবা আবার মসৃণ কাঁদা মাটি দিয়ে প্রতিমার বিভিন্ন অংশের ক্ষত পুননির্মাণে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
সরেজমিনে ঢাকেশ্বরী মন্দির ঘুরে দেখা গেছে, নির্মিত দেবী দূর্গার প্রতিমার দ্বিতীয় পর্বের কাজ দোমেটে শেষ করে ঢেকে রেখে দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রতিমা নির্মাণ শ্রমিকদের দেখা মেলেনি। তবে স্থানীয় মন্দিরে উপস্থিত ভক্তবৃন্দদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে নির্মাণ শ্রমিকেরা অর্ডারের অন্য প্রতিমা নির্মাণের কাজে গিয়েছেন ।
এদিকে বিগত বছরের তুলনায় চলতি বছরে প্রতিমার মূল্য কমে যাওয়া এবং নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়া অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন প্রতিমা তৈরির কারিগররা। একই সঙ্গে বিগত বছরের তুলনায় প্রতিমার চাহিদা কমে অর্ধেকে নেমে যাওয়ায় খরচ শেষে লাভের মুখ দেখা নিয়ে শঙ্কাও প্রকাশ করছেন তারা।
এমন পরিস্থিতির কারণ হিসেবে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে টালমাটাল পরিস্থিতিকে দায়ী করছেন মৃৎশিল্পীরা।
রমনা কালী মন্দিরের প্রতিমা শ্রমিক রতন পাল বলেন, পরিবেশ পরিস্থিতি ভালো না। দেশের যে অবস্থা এই পরিস্থিতিতে কোথাও পূজা হয়, কোথাও হয় না। কোন কমিটির কেউ কোন দায়িত্ব নিতেও চায় না। কত কী সমস্যা আছে। তাছাড়া গত বছর আমি যেভাবে কাজ করেছি এ বছর তার অর্ধেক মূল্যে কাজ করছি। তারপরও ভাবি যে দেখি মণ্ডপগুলো ধরে রাখা যায় কিনা।
প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম প্রতিবছরের মতন এবারও কাজ হবে। আমরাও সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। মাঝে দেশে ঝামেলার কারণে এক মাসের বেশি সময় আমরা কাজ করতে পারিনি। গতবারের মতন এবার অর্ডারও নেই। গতবছর ১৬টা প্রতিমার কাজ করেছি। এ বছর ৯টা প্রতিমার কাজ করছি।
এ বছর সর্বোচ্চ অর্ডার কত এবং অনুরূপ প্রতিমার মূল্য গত বছর কত ছিল, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এবছর সর্বোচ্চ অর্ডার ৮০ হাজার। এই একই প্রতিমা গত বছর ছিল ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
তিনি আরও বলেন, গত আড়াই মাস ধরে ৬ জন মানুষ এক সাথে কাজ করছি। এরপর বাঁশ-কাঠ-মাটি-খড় আরওতো কতকিছু আছে, সবই নিজের খরচ। আমিনবাজার থেকে মাটিও আমাদের ফিট হিসেবে কিনে আনতে হয়। বেলে মাটি কিনে আনতে ২০০ ফিট মাটির দাম পড়ে ৬ হাজার টাকা। এঁটেল মাটি কিনতে লাগে ১৫/১৬ হাজার টাকা। তারপর নিয়ে আসা-যাওয়া খরচ আছে আরও। এই বিচুলি (খড়) এক এক মুঠো কিনছি ১১ টাকা করে। এক মুঠো বিচুলি দিয়ে একটা হাতের কাজও হয় না। তারপর আবার ভ্যান ভাড়া আছে। আমি যদি ৩০০ মুঠোও কিনে আনি তাহলেও ৬০০ টাকা ভ্যান ভাড়া আছে। এরপর রং খরচ, প্রতিমার সাজসজ্জা কেনার খরচ, কত খরচ; কিন্তু প্রতিমার দাম নেই।
বিবেক পাল বলেন, এবার আমাদের প্রতিমার অর্ডার কম। গতবছর আমদের ১২/১৩টা প্রতিমার অর্ডার ছিল। এবার অর্ডার কমে গেছে। মাত্র ১০টা অর্ডার পেয়েছি। এবার প্রতিমার অর্ডারই ছিল না। শুরুতে দেশের এই পরিস্থিতিতে কেউই অর্ডার দেয়নি। শেষে এসে তবুও এগুলো অল্প টাকায় অর্ডার নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, মালিক অর্ডার ধরে, আর আমরা কাজ করি। তারপর মাসিক হিসেব করে লাভের একটা অংশ আমাদের দেয়। কিন্তু প্রতিমার বর্তমান যে বাজার সেখানে তো কিছুই থাকবে না মালিকের। মালিকের যদি না থাকে, তাহলে আমাদের কী দেবে? মালিক বাঁচলে আমরা বাঁচবো।