জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পাহাড়ে হামলার তদন্তের দাবি

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা ২৪. কম, ঢাকা | 2024-09-29 14:25:09

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও রাঙামাটি শহরে সম্প্রতি পাহাড়িদের ওপর হামলার ঘটনা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধায়নে তদন্তের দাবি জানিয়েছেব ভুক্তভোগীরা। একইসঙ্গে সহিংসতা ও হামলার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা।

রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান তারা। ‘দীঘিনালা-খাগড়াছড়ি-রাঙামাটিতে হামলার শিকার ব্যক্তিবর্গ’ ব্যানারে এই সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংঘাতে আহত ও প্রত্যক্ষদর্শী কুকুমনি চাকমা। তিনি বলেন, ৪৮ ঘণ্টা ধরে চলা এই বর্বরোচিত হামলায় চার জন নিহত ও শতাধিক আহত হন, যারা সবাই পাহাড়ি। সংজ্ঞাহীন গুরুতর আহত দু'জন চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। দীঘিনালায় ১০৫টি দোকান ও রাঙামাটিতে ছোট-বড় অন্তত ১০০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হামলাকারী সেটলার বাঙালিরা রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অফিসেও হামলা চালায় এবং সেখানে গ্যারেজে রাখা ৯টি গাড়ি ও একটি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মৈত্রী বিহারে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। হামলা শেষ হওয়ার পরই কেবল প্রশাসন রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঘটনার পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন উপদেষ্টা রাঙামাটি সফর করেন। অন্যদিকে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম দীঘিনালায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং স্থানীয় জনগণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে মত বিনিময় করেন।

তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার সরকার ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও হামলা, খুন ও লুটপাটের সাথে জড়িত কাউকে এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি। অন্যদিকে পাহাড়িদের মধ্যে এখনও ভয় ও আতঙ্ক কাটেনি। হামলার ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা লাইভ করেছিলেন তাদের পুলিশ গ্রেফতারের জন্য খোঁজ করছে বলে জানা গেছে।

তিনি অভিযোগ করেন, মাইকে ঘোষণা দিয়ে পাহাড়িদের ওপর হামলা করতে বাঙালিদের উস্কানি দেয়া হয়। এই ঘোষণার সাথে সাথে বোয়ালখালি, জামতলি ও গরু বাজারের দিক থেকে শত শত সেটলার বাঙালি ধেয়ে আসে এবং পাহাড়িদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। এ সময় সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে সেটলারদের পক্ষ নেয়, এবং ফাঁকা গুলি করে ভয়ভীতি দেখিয়ে পাহাড়িদের তাড়িয়ে দেয়। এরপর সেটলাররা বটতলা ও লারমা স্কোয়ারে পাহাড়িদের দোকানে ব্যাপক লুটপাট চালায় ও আগুন ধরিয়ে দেয়। হামলায় মোট ১০৫টি দোকান পুড়ে যায়, যার মধ্যে বাঙালিদের ২৬টি ও পাহাড়িদের ৭৯টি। হামলার সময় আগুন ধরিয়ে দেয়ার জন্য সাদা গান পাউডার ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

তিনি বলেন, ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সংঘবদ্ধ উগ্রবাদী সেটলাররা পাহাড়িদের ওপর হামলা, দোকানে লুটপাট ও আগুন দিলেও, অনেক বাঙালি এই হামলা থেকে বিপদগ্রস্ত পাহাড়িদের রক্ষা করেছে বলে জানা গেছে।

দীঘিনালা হামলার প্রতিবাদে খাগড়াছড়ি-পানছড়ি সড়কে হাজার হাজার পাহাড়ি রাস্তায় নেমে পড়ে। তারা সেনাবাহিনীর সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। এ সময় খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের সামনে রাস্তায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা গুলি করলে জুনান চাকমা (২২) ও রুবেল ত্রিপুরা (২৪) নামে দু'জন নিহত ও ২১ জন আহত হয়।

দীঘিনালা ও খাগড়াছড়িতে সেনা-সেটলার হামলার প্রতিবাদে “সংঘাত ও বৈষম্য বিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন” রাঙামাটি শহরে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। মিছিলটি সকাল পৌনে ১০টার দিকে জিমনেসিয়াম থেকে শুরু হয়ে বনরূপা পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত যায়। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় বাঙালিরা মিছিলের পেছন দিকে হামলা চালায়। এতে অনিক কুমার চাকমা (১৯) নামে এক ছাত্রকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

কুকুমনি চাকমা আরও বলেন, জুলাই-আগষ্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হলে আমরা পাহাড়ি জনগণও নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে আত্মমর্যাদাসহ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের স্বপ্ন দেখেছিলাম। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে স্বাধীনতার স্বাদ নিতে উদগ্রীব ছিলাম। কিন্তু আজ এ হামলার পর আমাদের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। সরকার ঘটনা তদন্তের জন্য ৭ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, কিন্তু এই কমিটির ওপর আমাদের কোন আস্থা নেই৷

এসময় নিহত ধনরঞ্জন চাকমার ছেলে বিনক চাকমা বলেন, যেখানে সেনাবাহিনী দেয়া হয়েছে আমাদের রক্ষা করার জন্য, আমাদের নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু এখন দেখি সেনাবাহিনী আমাদেরকে গুলি করছে, আমাদেরকে মারছে। আমরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। আমরা এখন আর এই সেনাবাহিনীকে চাইনা। আমি আমার বাবার হত্যা সুষ্ঠু বিচার চাই এখন।

এছাড়া নিহত জুনান চাকমার মা রূপসী চাকমা এবং নিহত রুবেল ত্রিপুরার মা নিরন্তা ত্রিপুরা তাদের সন্তানের হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানায়। পাশাপাশি দোষীদের বিচারের আওতায় আনার দাবিও করেন।

এসময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট ৫ দফা দাবি জানান তারা। তাদের দাবি গুলো হলো:

জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ও অংশগ্রহণে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা ও স্বনির্ভর এলাকায় এবং রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও হামলার তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে; জানমালের ক্ষয়ক্ষতি নির্ণয়পূর্বক উক্ত তদন্ত কমিটির সুপারিশ ও নির্দেশনা মোতাবেক নিহত-আহতদের পরিবার, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; অতিদ্রুত বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসারত আহতদের সুচিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে; হাসিনা সরকারের পদায়িত সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সঙ্গে জড়িত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের বরখাস্ত এবং প্রচলিত ও সেনা আইনে বিচার করতে হবে; এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং সেনাশাসন ও সেটলারদের প্রত্যাহার করতে হবে।

এসময় সংবাদ সম্মেলনে নিহতের স্বজন, আহত এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা উপস্থিত ছিলেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর