খুলনায় কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরিতে হুমকিতে পরিবেশ

খুলনা, জাতীয়

মানাজারুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 10:47:26

খুলনার রূপসা নদীর কোল ঘেঁষা অঞ্চলে অবৈধ চুল্লিতে অবাধে কাঠ পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে কয়লা। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বিভিন্ন বনজ ও ফলজ গাছ কেটে এসব চুল্লিতে কাঠ সরবরাহ করা হচ্ছে। কাঠ থেকে কয়লা তৈরির এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছেন স্থানীয় অনেকে। এসব কয়লা তৈরির চুল্লি থেকে নির্গত হচ্ছে প্রচুর ধোঁয়া। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগও আমলে নিচ্ছেন না এ ব্যবসায় জড়িতরা।

শুক্রবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রূপসা উপজেলার শিরগাতি, নৈহাটি রামনগর, যুগিহাটি, নারায়নখালীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে প্রায় ২০টি কয়লা তৈরির বিশেষ ধরনের অবৈধ চুল্লি। বিশেষ ধরনের এ চুল্লিতে কাঠ পুড়িয়ে কয়লা বানানো হয়। কাঠ পোড়ানোর সময় নির্গত হয় প্রচুর কালো ধোঁয়া। এতে একদিকে বনজ সম্পদ নষ্ট হয়, অপরদিকে ধোঁয়ার কারণে শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত নানা রোগব্যাধি হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। কয়লা তৈরির এ প্রক্রিয়ায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের ওপরও মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য মতে, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরের কোনো অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব কয়লা তৈরির কারখানায় অবাধে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। অবৈধ থাকা সত্ত্বেও জনবসতি এলাকায় ও ফসলি জমি নষ্ট করে এসব চুল্লি স্থাপন করা হয়েছে। শক্ত কাঁচা লাল মাটি, ইট ও কাঠের গুঁড়া মিশিয়ে তৈরি করা চুল্লিতে প্রতিদিন কয়েকশ মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। একটি চুল্লিতে সপ্তাহে কমপক্ষে ৩০০-৩৫০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়।

স্থানীয় বাসিন্দা কৃষক আব্দুর রহমান মিয়া বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'কয়লা পোড়ানোতে আমাগে এলাকায় আগের মতো ফসল হয় না। গাছের মাথায় মড়ক পরে। যহন কাঠ পোড়ায়, তহন আমরা শ্বাস করতে পারিনা। তরতরি এই কয়লা বানানো বন্ধ না করলে আমাগে আরও সমস্যা হবে।'

স্থানীয় স্কুল ছাত্র আশিকুর রহমান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির এ কাজটা এখানে কয়েকবছর ধরে করা হয়। যখন চুলায় কাঠ পোড়ানো হয় তখন ধোঁয়ায় চোখ জ্বালাপোড়া করে। অনেক সময় কাশিও হয়। বিকেলে আর সন্ধ্যায় চুলা জ্বালানো থাকলে চোখ জ্বালাপোড়াতে পড়তে পারি না আমরা।'

খুলনা সিভিল সার্জন ডা. এ এস এম আব্দুর রাজ্জাক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'কয়লা তৈরিতে কাঁচা কাঠ পোড়ানো হয়। এতে বাতাসে কালো ধোঁয়া আর কার্বন ও শিশা নির্গত হয়। এসব চুল্লির কালো ধোঁয়া শ্বাস-প্রশ্বাসে মাধ্যমে স্থানীয় এলাকার মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে অ্যাজমা, ফুসফুসের শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগ, শ্বাসনালী চিকন হয়ে যাওয়া, এলার্জি, চোখের প্রদাহ, ব্রঙ্কাইটিসসহ নানাবিধ রোগ হতে পারে। যে এলাকায় এসব চুলায় কাঠ পুড়িয়ে ধোঁয়ার তৈরি করা হয়, সেখানে শিশুরা জন্মগত ভাবে ফুসফুসের সমস্যা নিয়েই জন্ম নেবে।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়লা শ্রমিক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'প্রতিটি চুল্লিতে প্রতিবার ২০০ থেকে ২৫০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়। কাঠ পুড়ে কয়লা হতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ দিন। কয়লা বের করে ঠান্ডা করে চটের বস্তায় ভরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। প্রতি বস্তা কয়লা ৩৫০-৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়। এসব কাঠ কয়লা ব্যবহার হয় হোটেল-রেস্তোরাঁসহ আরও অনেক জায়গায়। কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরি অবৈধ হলেও এ ব্যবসায় অল্প পুঁজিতে ভালো লাভ হয়। তাই লাভের আশায় এ ব্যবসা করেন অনেকে।'

পরিবেশ অধিদফতর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক হাবিবুল হক খান বার্তা২৪.কম-কে বলেন, 'রূপসা এলাকায় দীর্ঘদিন যাবত কাঠ পুড়িয়ে কয়লা তৈরির অবৈধ এ কাজটি করা হচ্ছে। সরকারি কোনো অনুমোদন ছাড়াই কয়লার কারখানা স্থাপনের বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। দীর্ঘদিন যাবৎ কয়লা তৈরির চুল্লির কালো ধোঁয়ায় শিশুসহ এলাকার মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিচ্ছে। এ কয়লা তৈরির প্রক্রিয়ায় এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি ও গাছপালা। তাছাড়া জীববৈচিত্রও হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। নিয়মিত কয়লা বানানোর ফলে খুবই দ্রুতই এ এলাকায় অক্সিজেন ঘাটতিসহ নানা প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগ বালাই বৃদ্ধির আশংকা রয়েছে। অভিযোগ পেয়ে আমরা ডিসি অফিসের ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে অভিযানে গিয়ে ১০টি অবৈধ চুল্লি পেয়েছি। লাভ বেশি বলে অভিযানে এসব চুল্লি বন্ধ করার পর আবার এ কাজ শুরু হয়। দ্রুত সময়ের ভেতরে তদন্ত করে আরও অভিযান করে চুল্লি বন্ধসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।'

এ সম্পর্কিত আরও খবর