ঘুরে দাঁড়াতে অভাবী মেয়ে কামরুন্নাহারের সংগ্রাম

ময়মনসিংহ, জাতীয়

রাকিবুল ইসলাম রাকিব, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ), বার্তা২৪.কম  | 2023-08-29 03:51:37

ছোট একটা কুঁড়েঘর। সামনে ছোট একটা উঠান। সেখানে বসে ছোট একটি মেয়ে পাঠ্যবই সামনে নিয়ে বেত বুনে ধাড়ি (চাটাই) তৈরি করছে। মেয়েটি কিছুক্ষণ বেত বুনে, তার ফাঁকে কিছুক্ষণ বই পড়ে। এভাবেই বুনন ও বইয়ের পাতায় একটু একটু নজর দিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ধাড়ি তৈরি করে চলেছে।

গতকাল শুক্রবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ২ নং গৌরীপুর ইউনিয়নে বায়রাউড়া গ্রামের একটি বাড়িতে এ দৃশ্য চোখে পড়ে।

কাছে গিয়ে কথা হয় মেয়েটির সঙ্গে। বার্তা২৪.কমকে তিনি জানান, তার নাম মোছা. কামরুন্নাহার। অভাবের সংসারে সারাক্ষণ কাজ করতে হয় বলে কলেজের পাঠ্যবই পড়ার সময় পান না। তাই বেত বুননের ফাঁকে ফাঁকে পড়েন তিনি।

কামরুন্নাহারের বাড়ি বায়রাউড়া গ্রামে। তিনি পড়াশোনা করছেন জেলার আনন্দমোহন কলেজের অনার্স বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে। তার বাবা সাইদুর রহমান। মা আছমা খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়।

কথা বলতে বলতেই বুননের কাজ করে চলেছেন কামরুন্নাহার। হাতের নিপুন কৌশলে বেত বুনতে বুনতে একটি ধাড়ি তৈরি করে ফেলেছেন কয়েকঘণ্টার মধ্যেই। বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, ‘আমার দরিদ্র বাবা শহরে ফেরি করে কলা বিক্রি করে। কিন্তু তার একার আয়ে ভাইবোনদের পড়াশোনার খরচ তো দূরের কথা, তিনবেলা খেতেই পারতাম না। বড় বোন শামসুন্নাহার অনেক কষ্টে এইচএসসি পাশ করলেও টাকার অভাবে ভর্তি হতে পারেনি। তাই পড়াশোনার খরচ নিজে জোগাতে বেতের কাজ, টিউশনি ও খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করি। একই সঙ্গে সংসারের হাল ধরার পাশাপাশি নিজের ও ভাইবোনদের পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।’

কামরুন্নাহের বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট দুই বোনের মধ্যে কারিমাতুন্নাহার দশম শ্রেণিতে ও তানিয়া আক্তার অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে তোফায়েল আলম প্রথম শ্রেণিতে ও তৌহিদুল ইসলাম শিশু শ্রেণিতে পড়ে। এরমধ্যে দুই বোন প্রতিবন্ধী হলেও তারা সরকারি কোনো ভাতা পায় না।

২০১৫ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে কামরুন্নাহার বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে দুই বছরের অর্থবৃত্তি পান। কিন্তু ২০১৭ সালে এইচএসসিতে অল্পের জন্য জিপিএ-৫ ছুটে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় তার অর্থবৃত্তি। এরপর কিছুটা অর্থকষ্টের মধ্যে পড়ে যান কামরুন্নাহার। কিন্তু অদম্য মনোবল নিয়ে অভাব জয়ের যুদ্ধে নেমেছেন তিনি।

প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে ভাইবোনদের নিয়ে পড়তে বসেন কামরুন্নাহার। এরপর তিনি টিউশনি করানোর জন্য চার কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে উপজেলা শহরে যান। টিউশনি শেষ করে একটি স্কুলে পাঠদান করান তিনি। টাকার অভাবে বাসের বদলে গৌরীপুর থেকে ট্রেনে চড়ে ময়মনসিংহ শহরে নিজ কলেজে যান। কলেজে ক্লাস শেষে সন্ধ্যার ট্রেনে বাড়ি ফেরেন তিনি।

বার্তা২৪.কমকে কামরুন্নাহার বলেন, ‘সংসার ও ৫ ভাইবোনের পড়াশোনা বাবদ প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা বেত বুনে আয় করি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। বাবা কিছুটা সহযোগিতা করলেও টানাটানি থাকে। আমি টিউশনি করে ২ হাজার টাকা সংসারে দেই। সংসারের হাল ধরতে ছোটবোন সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। কিন্তু টাকার অভাবে মেশিন কিনতে পারিনি। তাই মেশিন কিনতে এখন আরেকটি টিউশনি নিয়েছি। কিন্তু আমিও তো ছোট মানুষ, শরীরে এত পরিশ্রম সহ্য হয় না।’

এরই মাঝে সকালের বেলা দুপুরে গড়িয়েছে। মসজিদে বেজে উঠেছে আজানের ধ্বনি। এমন সময় বাড়িতে প্রবেশ করেন কামরুন্নাহের বাবা সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার ৫টা পোলা-মাইয়্যা কষ্ট কইর‌্যা লেহাপড়া করতাছে। ওরা ভালা খাইতারেনা, ভালা কাপড় পায় না। তাই গেরামের মানুষ আমারে কয় তুমি অভাবী মানুষ মাইয়্যাগোরে লেহাপড়া করাইয়্যা কী করাইবা? হেরচেয়ে ভালা বিয়া দিয়া দেও। এই কথাডা হুনলে খুব দুঃখ লাগে।’

বাবার কথার রেশ টেনে কামরুন্নাহার বলেন, ‘দুঃখ করো না বাবা। দুই বছর পর আমার অনার্স শেষ হলে আমি চাকরি করব, শিক্ষক হব। তখন আমাদের কোনো অভাব থাকবে না। আর ছোটরাও তখন দাঁড়িয়ে যাবে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর