নিত্যপণ্যের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে । পরিবারের বাজারের চাহিদা মেটাতে মানুষের যখন হিমসিম খেতে হচ্ছে তখন এক লাফে ৭০ এর ঘরে ওঠেছে গোল আলুর দাম। কিন্তু হঠাৎ এই আলুর দাম বৃদ্ধির পেছনের কারন কী সেটা নিয়েও সৃষ্টি হচ্ছে নানান জটিলতা।
পাইকারি আড়তদার ব্যবসায়িদের অভিযোগ কোল্ড স্টোরেজ থেকে উচ্চ দামে কিনতে হচ্ছে তাদের। ফলে বাধ্য হয়েই উচ্চ দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। কিন্তু ভোক্তা অধিদফতর বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, আলুর দাম বৃদ্ধির পেছনের আসল কারিগর আড়তদার ব্যবসায়িরা। কারণ কোল্ড স্টোরেজ থেকে যদি তাদের বেশি দামে কেনা লাগে বলে জানালেও প্রয়োজনীয় রশিদ দেখাতে পারেনি আড়তদাররা। তাই আলুর দাম বৃদ্ধি পেছনে আড়তদাররাই নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে বলে জানিয়েছে ভোক্তা অধিদফতর।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজারে নিত্যপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করে দিয়ে থাকে বাংলাদেশ সরকারের সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদফতর। এই সংস্থাটির দেয়া সবশেষ গত ৭ নভেম্বরের বাজার দরের তালিকা অনুযায়ি প্রতি কেজি দেশি সাদা গোল আলুর পাইকারী পর্যায়ে মূল্য নির্ধারণ করা হয় ৩৯টাকা।
কিন্তু সবশেষ গত ৭ নভেম্বরের বাজার দরের তালিকা দেওয়া থাকায় ৯ নভেম্বরের যৌক্তিক মূল্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে ভোক্তা অধিদফতর বলছে পাইকারি পর্যায়ে সরকার নির্ধারিত দাম কেজি প্রতি ৪৫ টাকা বিক্রির কথা। আর এদিকে খুচরা বাজারে গ্রাহক পর্যায়ে এই আলু প্রতি কেজি দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০টাকা দরে।
শনিবার (৯ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৮টায় রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় আলুর বাজারে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেন ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল।
অভিযানকালে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু ৬২ থেকে ৬৩ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। পাইকারি আলুর আড়তদার ব্যবসায়িদের ক্রয় ও বিক্রয় রশিদ দেখতে চান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
এসময় আড়ত ব্যবসায়িদের ক্রয় ও বিক্রয় রশিদ না থাকা ও ব্যবসায়িদের কথা মতন অলুর ক্রয়মূল্যের সাথে বিক্রয় মূল্যের অসামঞ্জস্য থাকায় তিনজন আলুর আড়তদার ব্যবসায়িকে ১৫ হাজার করে মোট ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
একই সঙ্গে দোকানিদেরকে এখন থেকে আইন মানার শর্তে ক্ষমা ও যৌক্তিক মূল্যে স্বল্প লাভে জনসাধারণের কাছে বিক্রির নির্দেশনা দেন জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
অভিযান শেষে আব্দুল জব্বার মন্ডল বলেন, আজকে আলুর উপরে আমরা বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছি। আমাদের কাছে যে তথ্য রয়েছে এবং আজকে যে আমাদের ফাইন্ডিংস একই রকমের। সেটি এমন যে যেখান থেকে আলুগুলো কেনা হয়েছে সেই ক্যাশ মেমো তারা দেখাতে পারছে না। ফলে বরাবরের মতই এই কেনা দাম অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। এই আড়তদাররা যাদের কাছে আলুগুলো বিক্রি করছেন তাদের ক্যাশ মেমো দেয়ার বিধান ছিল সেটিও প্রতি পালন করা হচ্ছে না। দুই থেকে চার জনকে পাঁকা ক্যাশমেমো দেয়া হয়েছে বাকি কাউকেই ক্যাশ মেমো দেয়া হয়নি। ব্যবসায়িদের ভাষ্য অনুযায়ী কাঁচামাল বিক্রেতা নাকি আইন মেনে ব্যবসা করতে পারেন না।
তিনি আরও জানান, আমাদের উপস্থিতিতে তারা জানালেন ৫৮ টাকা করে বিক্রির নির্দেশনা পেয়েছেন। কিন্তু দুই থেকে ৪ জনকে যে বিক্রির পাঁকা ক্যাশমেমো দিয়েছেন সেখানে আমরা দেখলাম ৬২ বা ৬৩ টাকা করে বিক্রি করেছেন। অর্থাৎ কেজি প্রতি প্রায় ৫ টাকা করে অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করছেন। আমরা অভিযানের পর এখন ব্যবসায়িরা ৫৮ টাকা করে মূল্য তালিকা প্রদর্শন করেছেন এবং ৫৮ টাকা করে বিক্রি করছেন। আরেকটি বিষয় আমরা দেখলাম খুচরা বিক্রেতারা আমাদের উপস্থিতি জানতে পেরে আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখান থেকে তারা দোকান ফেলে রেখেই চলে যাচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে তারা কোন দামে বিক্রি করছেন সেটিও মনিটরিং করতে আমরা এখানে এসেছিলাম কিন্তু সেটি আমরা পারলাম না।
এই কারওয়ানবাজার থেকে ঢাকা মহানগরীর যে অন্যন্য বাজারগুলো আছে তারাও আলু এখান থেকেই কিনে থাকে। যেহেতু এই কারওয়ান বাজার থেকে পাঁকা রশিদ দেয়া হচ্ছেনা সেহেতু আমরা যখন অন্যন্য বাজারে অভিযান পরিচালনা করে থাকি তখন তারা বলেন কারওয়ান বাজার থেকে আমরা আলু কিনেছি কিন্তু পাঁকা ক্যাশমেমো দেয়া হয়নি। কী দামে কিনেছেন জানতে চাইলে তারা বলেন বেশি দামে কিনেছি। আসলে আমরা অন্ধকারের ভেতরেই থেকে যাচ্ছি। এসকল কারনেই আসলে আলুর দামটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। আমরা তাদের কাছ থেকে কমিটমেন্ট নিয়েছি, তারা জানিয়েছেন আজকে থেকেই তারা পাঁকা ক্যাশমেমো দিবেন এবং যেখান থেকে পণ্য কিনেছেন সেখান থেকেও তারা পাঁকা ক্যাশমেমো সংগ্রহ করবেন। যদি কেউ পাঁকা ক্যাশমেমো দিতে রাজি না হয় তাহলে সেই তথ্য আমাদের কাছে জানাবেন। আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবো।
এছাড়া, ক্রয় বিক্রয়ের পাঁকা ক্যাশ মেমো না থাকা ও বেশি মূল্যে বিক্রির কারনে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আড়তদাররা মূলত এই অভিযোগ করে বার বার। এক হচ্ছে তারা বলেন খুচরা ব্যবসায়িরা বেশি দাম রাখছেন আর দ্বিতীয় হচ্ছে কোল্ডস্টোরেজ থেকে তাদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে এবং তারা পাঁকা ক্যাশমেমো দিচ্ছে না। তখন আমরা তাদের তথ্য চাইলে তারা তথ্য দিতে পারেন না। তার মানে এরা (আড়তদাররা) নিজেরাই দাম বৃদ্ধিতে জড়িত বলে আমাদের মনে হচ্ছে।
সরকার নির্ধারিত যে দাম সেই দামের অতিরিক্ত তারা বিক্রি করছে। আসলে নিয়মটা এমন কিনা যে তারা বেশি দামে কিনে এনেছেন তাই বিক্রি করছেন নাকি নির্ধারিত দামেই বিক্রি করতে হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা যদি ৫৮ টাকা কেজি প্রতি বিক্রি করেন তাহলেও তাদের একটা যৌক্তিক লাভ থাকবে। কিন্তু তারা অযৌক্তিক ভাবে সেই ৫৮ টাকার আলু বিক্রি করছেন ৬৩ টাকা। যদিও সরকারের বেঁধে দেয়া দাম হচ্ছে ৪৫ টাকা। আসলে ৪৫ টাকা কেজি দরেই বিক্রি করার কথা ছিল কিন্তু তাদের কেনা যেহেতু একটু বেশি দামে তাই বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন তারা। কিন্তু কোন রেটে (দামে) তারা কিনেছেন সেই তথ্য তারা দিতে পারেননি।
আমরা চেষ্টা করছি কারা এই কারসাজি করে মূল্য বৃদ্ধির পেছনে কাজ করছেন, কারা এর পেছনে জড়িত তাদেরকে খুজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া, এই অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছেন ভোক্তা অধিদফতর কর্মকর্তা।