ফুল চাষি সাঈদ, নিঃস্ব থেকে লাখপতি

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, রংপুর, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 23:27:29

শ্রম আর ইচ্ছা শক্তি থাকলে মানুষ যে সফল হতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আবু সাইদ। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী এ যুবক পরীক্ষার খাতায় ফেল করলেও জীবন যুদ্ধে জয়ী। তার মাসিক আয় এখন প্রায় ৪০ হাজার টাকা। অভাব এখন আর তার দুয়ারে হানা দিতে পারে না। ফুল চাষ করেই তিনি এখন লাখপতি।

তামাক চাষে অন্য সবাই যখন ব্যস্ত, তখন মাত্র ২৫ শতক জমি নিয়ে গোলাপের চাষ শুরু করেন সাঈদ। এক বছরের মাথায় লাভের অংশ বৃদ্ধি হতে থাকে। সঙ্গে তার চাষাবাদে যুক্ত হতে থাকেন গ্রামের স্থানীয় মানুষরা।

এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করা সাঈদের ফুল চাষ দেখে গ্রামের অনেকেই তামাক চাষ ছেড়েছেন। বিষাক্ত তামাকের জমিতে এখন গোলাপের মিষ্টি হাসি। আর সাঈদের সেই স্বল্প পরিসরের ফুল চাষ এখন বেড়ে পৌঁছেছে ছয় একর জমিতে।

সাঈদ স্বাবলম্বী হওয়ায় যেমন হাসি ফুটেছে তার পরিবারের অন্যদের মুখে। তেমনি গ্রামের প্রায় ৩০টি পরিবারের তিন শতাধিক নারী ও পুরুষের কাজের ব্যবস্থা হয়েছে সাঈদের নার্সারিতে। পনের বছরেরও বেশি সময় ধরে ফুলের চাষ আর ব্যবসা থেকে সাঈদ কিনেছেন কয়েক বিঘা জমি। তৈরি করেছেন ঘর-বাড়ি।

সাঈদের নার্সারিতে বছর জুড়েই থাকে ফুলের চাহিদা। তবে শীত মৌসুম এলে চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেয়ে হয় তার কর্মীবাহিনীকে। গোলাপের পাশাপাশি ছয় ধরণের ফুল চাষ করছেন তারা। রংপুরের ফুল ব্যবসায়ীদের চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা ও সিলেটেও যাচ্ছে এসব ফুল।

রংপুর মহানগরীর উত্তম হাজিরহাট মুচির মোড় এলাকার বাসিন্দা আবু সাঈদ। সাঈদ এখন বেশির ভাগ সময় ঢাকায় থাকেন। সেখানে ফুলের দোকান গড়েছেন। সিলেটের বিয়ানী বাজারেও তার ফুলের দোকান রয়েছে। দু’ একদিন পর পর রংপুর থেকে সেখানে ফুল পাঠানো হয়।

রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের কোল ঘেঁষে উত্তর হাজিরহাট মুচির মোড়। এই এলাকার থেকে গ্রামের একটু ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে নানা ধরনের গোলাপের সমারোহ। বিশাল মাঠে গোলাপের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের ফুল চাষ হচ্ছে। দেখলে মনের প্রশান্তির পাশাপাশি চোখ জুড়িয়ে যাবে।

বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় কাটান সাঈদের বড় ভাই আবদুস সালাম। ঘরের সাথেই বাগান হওয়ায় সারাদিন ফুলের সাথেই পড়ে থাকেন তিনি। পড়ালেখা না জানা থাকলেও সালাম জানেন ফুলকে ভালোবেসেই আজকের তাদের উন্নতি হয়েছে। 

তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, আগে তাঁদের পরিবারের লোকেরা তামাক চাষ করতেন। সাঈদ ফুল চাষ করে সংসারে আয় বেড়ে যাওয়ায় এখন সবাই ফুলের চাষাবাদ নিয়েই ব্যস্ত। তামাকের জমিতেই এখন ফুলের চাষ হচ্ছে। অভাব অনটন নেই। সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ ভালোই দিন কাটাচ্ছেন। তাদের সাথে গ্রামের ১৮ জন নিয়মিত কর্মচারীর পাশাপাশি ফুলের মালা তৈরির জন্য আড়াই’শ নারী শ্রমিক চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন।

ভাতিজা সাজু আহমেদ জানান, প্রথম স্বল্প পরিসরে ২৫ শতক জমিতে গোলাপের চাষ শুরু করেন তার ছোট চাচা আবু সাঈদ। ফুলের চাষাবাদে লাভ বেশি হওয়াতে ধীরে ধীরে জমির পরিধি বাড়তে থাকে। এখন প্রায় ৬ একর জমিতে গোলাপ, গাধা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, কাঠবেলি, দেশি বেলিসহ সময় উপযোগী নানা জাতের ফুল চাষ করা হয়। ঢাকা ও সিলেটের পাশাপাশি রংপুরসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে তাদের ফুল যাচ্ছে।

বাড়িতে বসে বসে কাঠ বেলি, দেশি বেশি, গাধা, রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন ফুলের মালা ও চেইন তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন প্রায় দুই শতাধিকের বেশি নারী। তাঁদের মধ্যে কোহিনুর আর ইসমত আরার সাথে কথা হয়। তাঁরা জানান, প্রতিদিন তারা চুক্তিভিত্তিক ২০০-৪০০ টাকা করে আয় করছেন। এতে তাদের সংসার ও ছেলে মেয়েদের পড়াশুনার খরচ চালাতে সুবিধা হচ্ছে।

অন্যদিকে সাঈদের নার্সারির তত্ত্বাবধায়ক রহমত উল্লাহ্ বলেন, আমি নিজেই এক সময় খুব অভাবে ছিলাম। সংসার আর বাড়ি-ঘরের অবস্থা ভালো ছিল না। সাঈদের ফুল বাগানে চাকরি নেয়ার পর থেকে ভালো আছি। এখন প্রতি মাসে ১৫ হাজার বেতন পাচ্ছি। সংসারে আয়-উন্নতি বেড়েছে।

ঢাকায় থাকা আবু সাঈদের সাথে মুঠোফোন কথা হয়। তিনি জানান, বর্তমানে তিনি প্রায় ছয় একর জমিতে গোলাপ ও গাধাসহ নানা জাতের ফুলের চাষ করছেন। খরচ ও কর্মচারীর বেতন বাদে ফুল বিক্রি করে তাঁর মাসিক আয় গড়ে ৩০-৪০ হাজার টাকা। এই আয়ের কারণে সংসারের উন্নতির সাথে সাথে ব্যবসা ও চাষাবাদ বেড়েছে।

সাঈদ বলেন, এইচএসসি পরীক্ষায় ফেল করার পর খুব হতাশায় ছিলাম। রাগ করে ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ফিরে এসে গোলাপ চাষ শুরু করি। সেই থেকেই ফুলের চাষ করে যাচ্ছি। দীর্ঘ বছরের এ চাষাবাদে তিনি কৃষি বিভাগ থেকে কোন সহায়তা বা পরামর্শ পাননি বলেও জানান এ যুবক।

এব্যাপারে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মো. খোরশেদ আলম জানান, আমাদের কাছ থেকে সহযোগিতা চাইলে অবশ্যই তা পেত। তবে এখন থেকে তার বিষয়টি আমরা খোঁজখবর রাখব। সরকারের পক্ষ থেকে যতটুকু সহযোগিতা করা যায়, আমরা চেষ্টা করব। 

এ সম্পর্কিত আরও খবর