খুলনায় নদী দখল করে ইটভাটা, হুমকিতে পরিবেশ

খুলনা, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, খুলনা, বার্তা২৪.কম | 2023-08-25 14:16:55

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার হরি ও ভদ্রা নদীর ৪ কিলোমিটার এলাকায় জমি ইজারা নিয়ে গড়ে উঠেছে ১৮টি ইটভাটা। ইটভাটার মালিকরা নদী তীরবর্তী জায়গা ইজারা নিলেও ধীরে ধীরে নদী দখল করে ভাটা নির্মাণ করছে। এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে। জোয়ার-ভাটায় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে নদীর উপর নির্মিত সেতু।  একই সাথে নদীর পূর্ব পাড়ের খর্ণিয়াবাজার, ভদ্রদিয়া ও রানাই গ্রামের প্রায় সাড়ে তিনশ বাড়ি ভাঙন হুমকির মুখে পড়েছে। সেই সাথে দূষিত হচ্ছে এলাকার পরিবেশ।

সরেজমিনে  ঘুরে দেখা গেছে, এই ভাটাগুলো নদীর পশ্চিম পাশে উত্তর-দক্ষিণে প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে নদীর ভেতরে অর্ধেক জায়গা (২০-২৫ ফুট) দখল করে ফেলেছে।  এ কারণে নদীর গতি পরিবর্তন করে পূর্ব দিকে চলে আসছে। এতে ভাঙনের মুখে পড়েছে পূর্ব পাশের ওই সব স্থাপনা।

এলাকাবাসী জানায়, নদীর পাড়ে ভূমিহীন কৃষকেরা সরকারের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়েছিলেন।  সেই জমির সাথে ব্যক্তিগত জমি নিয়ে ২০০৯ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে ভাটা মালিকেরা ১৮টি ভাটা গড়ে তুলেছেন।  ভাটাগুলোর মালিকেরা নদীতে বাঁধ দিয়ে ছোট ছোট পুকুর নির্মাণ করছেন। এসব পুকুরে জমা পলিমাটি দিয়ে তাঁরা ইট তৈরি করছেন।  এভাবে বাঁধ দেওয়ায় নদীর স্রোত কমে যাচ্ছে। পলি পড়ে নদীটি নাব্যতা হারাচ্ছে।  এ ভাটাগুলো অধিকাংশ বসত বাড়ির ১০ থেকে ১০০ গজের মধ্যে।  বসত বাড়ি কাছে হওয়ায় ভাটার ধোঁয়া-বালিতে অতিষ্ট হয়ে উঠছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।  তাছাড়া ভাটার ধূলা আর কালি ফসলি জমিতে পড়ায় ফসল উৎপাদনও কমে গেছে।  অতিরিক্ত ইট বহন করার কারণে খর্ণিয়া-শোলগাতিয়া পাকা সড়কটিও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

নদী দখলকারী এসব ভাটা গুলো হলো, হাফিজুর রহমানের এবি ব্রিকস, হুমায়ন কবিরের  কেবি-১ ব্রিকস ও কেবি-২ ব্রিকস, শাহজাহান জম্মাদারের নূরজাহান ব্রিকস, গাজী আবদুল হাদীর সেতু ব্রিকস, গাজী ফজলুর রহমানের সাতক্ষীরা ব্রিকস, নারায়ন চন্দ্র চন্দের কেএমপি ব্রিকস, হাফিজুর রহমানের এবি ব্রিকস, এফএমবি ব্রিকস, ইসমাইল হোসেনের আলমদিনা ব্রিকস, মশিউর রহমানের মেরি ব্রিকস, লতিফ জম্মাদারের জেবি-১ ও জেবি-২ ব্রিকস, আমিনুল হকের লুইন ব্রিকস, গাজী আব্দুল হকের সেতু ব্রিকস, ইকবাল জম্মাদারের স্টোন ব্রিকস, অসীম কুমার দের প্রাইম ব্রিকস ও তুষারের টিএম ব্রিকস। এর মধ্যে হাফিজুর রহমানের এবি ব্রিকস, এফএমবি ব্রিকস, মশিউর রহমানের মেরি ব্রিকস, অসীম কুমার দের প্রাইম ব্রিকস ভাটার বৈধ কোন কাগজপত্র নেই।

আঙারদাহো গ্রামের এমদাত হোসেন বার্তা২৪.কম কে বলেন, ভাটাগুলো প্রতিনিয়ত নদী মেরে ফেলছে।  রাতের আঁধারে বস্তার মধ্যে ইটের ছোট-বড় টুকরো ভরে ভাটার সামনে নদীতে ফেলা হয়।  সেখানে পানি বাধা পেয়ে পলি জমছে তখন সেখানে বাঁধ দিয়ে দিচ্ছে।

রানাই গ্রামের আবু তালেব বলেন, ভাটার ধোঁয়া আর বালিতে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়ছে।  ওভার লোডেট ইট-ট্রলি ইট বহনের কারণে খর্ণিয়া-শোলগাতিয়া রাস্তাটি দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

মেরি ব্রিকসসের মালিক মশিউর রহমান বলেন, আমি নদীতে বাঁধ দেয়নি।  ইটভাটার লাইসেন্সের জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছি।  দ্রুতই লাইসেন্স পেয়ে যাবো।

খর্ণিয়া ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও খুলনা-৫ আসনের সাংসদ নারায়ণ চন্দ্র চন্দ বলেন, নদী দখল বন্ধ করা প্রশাসনের কাজ।  আমি ডিসি সাহেবকে জানিয়েছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডকেও বলেছি। কিন্তু তারা পদক্ষেপ না নিলে আমার কিছু করার থাকে না।  অবৈধ ভাটা ও নদী দখলদার ভাটার ব্যাপারে ঠিক ওই ভাবে খোঁজ নেওয়া হয়নি।  এখন খবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ জানান, সরকার বলছে নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। আর ভাটা মালিকরা বলছে নদী মরণে আমরা বাঁচব।  নদী দখল হলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লাভ বেশি। তারা খননের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাট করতে পারবে।  সেকারণে তারা কিছু বলে।  আর নদীটি ভরাট হলে নদীর পাশের বসবাসকারী ১০-১৫ গ্রামের হাজারো মানুষ বছরের ৮ মাস পানির নিচে ডুবে থাকবে।

পাউবো ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা অনেক বার নদী দখল মুক্ত ও খননের জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু ওই ভাটাগুলোর মালিকরা অধিকাংশই সরকার দলীয় ও প্রভাবশালী যে কারণে সকল উদ্যোগ ভেস্তে যাচ্ছে। কারণ আমরা এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা নই, এখানে চাকরি করতে এসেছি।

পাউবো খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বার্তা২৪.কম কে বলেন, নদীটি খননের জন্য ৫/৭ বছর আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে আজও তা হয়নি। সম্প্রতি ভাটাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করেছি। সেটা ঢাকা অফিসসহ সকল স্থানে পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে। তারপর নদী দখলের কার্যক্রম শুরু হবে।

খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, যারা নদী দখল করছে বা অবৈধ ভাবে ভাটা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ সম্পর্কিত আরও খবর