ছবিগুলোর দিকে তাকালে হঠাৎই চোখ আটকে যাবে বিস্ময়ে! এ ধরনের দৃশ্য আমাদের দেশে খুব একটা পরিচিত নয়। দেখে মনে হবে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার কোনো দেশের তুষারপাতের দৃশ্য এটি। কিন্তু রোববার (১৭ ফেব্রুয়ারি) ভোররাতে রাজশাহীর পুঠিয়াজুড়ে ভয়াবহ এ শিলাবৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় প্রবীণরা বলছেন- তাদের ৬০ বছরের জীবনে এমন ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি আগে কখনও দেখেন নি।
শিলাবৃষ্টির তীব্রতা এতোটাই ছিল যে, উপজেলার গ্রামগুলোতে টিনের চাল ছিদ্র হয়ে ঘরেও শিলা ঢুকে যায়। শিলাবৃষ্টি থামার তিন ঘণ্টা পরও বাইরে চলাচল করা সম্ভব হচ্ছিল না। স্থানীয়রা কোদাল দিয়ে কিংবা কাঠ দিয়ে রাস্তার শিলা সরিয়ে চলাচলের উপযোগী করে।
জানা যায়, রোববার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে হঠাৎ রাজশাহীজুড়ে শিলাবৃষ্টি ও দমকা হাওয়া শুরু হয়। তবে অন্য উপজেলাগুলো এর মাত্রা সহনীয় থাকলেও পুঠিয়ার তিনটি ইউনিয়নে শিলাবৃষ্টির তীব্রতা ছিল ভয়াবহ।
আবহাওয়া অফিস সূত্রমতে, রেকর্ড পরিমাণ শিলাবৃষ্টি হয়েছে পুঠিয়ার তিন ইউনিয়নে। যা এর আগে রাজশাহীতে কখনও হয়নি। উপজেলার বানেশ্বর, ভালুকগাছি ও জিউপাড়া ইউনিয়নে শিলাবৃষ্টিতে অধিকাংশ টিনের চালের বাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। শিলার প্রকোপে টিনের চাল শুধু ছিদ্রই হয়নি দুমড়ে-মুচড়ে গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শিলার আঘাতে ওই তিন ইউনিয়নে শতশত বাড়ি-ঘর, আম, কলা, লিচু, ভূট্টা, পেঁয়াজ, রসুন, আলুসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শিলার আঘাতে কয়েকটি টিনসেড স্কুলও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সকাল সাড়ে ৮টায় মধুখালি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, শিলাবৃষ্টি থামার ৪ ঘণ্টা পরও রাস্তায় স্তূপ পড়ে আছে। সড়ক দিয়ে কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। হেঁটে চলাও দায় হয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা কাঠের শক্ত তক্তা দিয়ে রাস্তা থেকে শিলা সরাচ্ছেন। প্রত্যেক বাড়ির উঠানে স্তূপ পড়েছে শিলার। যা সরাতে বাড়ির পুরুষ-মহিলা সকলে মিলেও হিমশিম খাচ্ছে।
পুঠিয়ার জিউপাড়ার বাসিন্দা ও রাজশাহী জেলা পরিষদের সদস্য আবুল ফজল বলেন, ভোররাতে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। এর প্রকোপ এতোটাই বেশি ছিল যে, আমার বাড়ির আশেপাশের মানুষ ভয়ে চিৎকার শুরু করে। আমরাও ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ভোরের আলো ফোটার পর বাইরে গিয়ে যা দেখলাম, তা ছিল অবিশ্বাস্য।
তিনি বলেন, আধাঘণ্টা স্থায়ী এ শিলাবৃষ্টিতে এলাকার ফসল তছনছ হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি এখনও নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। মৌখিকভাবে স্থানীয় সাংসদ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও ইউএনওকে জানানো হয়েছে।
মধুখালি এলাকার কৃষক তাহের আলী বলেন, আমার দুটো ঘরই টিনশেডের। শিলাবৃষ্টি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যায়। তখন টিন ছিদ্র হয়ে পুরো ঘরে শিলার স্তূপ জমা হয়। ভয়ে আমার স্ত্রী ও সন্তানরা তটস্থ হয়ে পড়ে। মাঠে পেয়াজ ও রসুনের চাষ ছিল। সকালে সেখানে গিয়েও দেখি, সব শেষ। এখন কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি ও আমচাষী আবেদ আলী বলেন, আমার ৬০ বছরের জীবনে এমন শিলাবৃষ্টি কখনও দেখিনি। আমার বেশ কয়েকটি আমের বাগান আছে। আগাম মুকুল এসেছিল সেগুলোতে। ভালো ফলনের আশা করছিলাম। কিন্তু গাছের বেশিরভাগ মুকুল ভেঙে পড়েছে। ফুলের চাষ ছিল, সেটাও বরবাদ হয়ে গেছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সালাহউদ্দীন আল ওয়াদুদ বলেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখন জানানো সম্ভব নয়। সকাল থেকে আমাদের লোকজন মাঠে কাজ করছে। আগামীকাল ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
দুপুরে মোবাইলে পুঠিয়া-দুর্গাপুরের সংসদ সদস্য ডা. মনসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমি স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে সকাল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় আছি। এখনও সব এলাকা ঘুরে দেখা শেষ হয়নি। যেটুকু দেখেছি এবং স্থানীয় মানুষের কাছে শুনেছি, তা অবিশ্বাস্য। এলাকার মানুষের ফসলি জমি, বাড়িঘর, আম-লিচু বাগানে ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। যা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে।’
সংসদ সদস্য আরও বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হবে। আশা করি- সরকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবে।