ভালো নেই রংপুরের ভাষা সৈনিকেরা

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, রংপুর, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 06:05:48

১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে। ভাষা সংগ্রামে পিছিয়ে ছিল না রংপুর। ১৯৪৮ থেকে ‘৫২ পর্যন্ত রংপুরের ছাত্র সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধারাবাহিকভাবে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন করেছেন।

মহান ভাষা আন্দোলনে রংপুরের যেসব ভাষাসৈনিক সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ৪/৫ জন আজও বেঁচে আছেন। রংপুরের প্রবীণ রাজনীতিক মোহাম্মদ আফজাল, শাহ তবিবর রহমান প্রধান, আশরাফ হোসেন বড়দা এবং মীর আনিসুল হক পেয়ারা তাদের মধ্যে অন্যতম।

রংপুর জিলা স্কুলের ছাত্রাবস্থায় ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন মোহাম্মদ আফজাল। বয়সে ছোট হলেও প্রতিটি মিটিং মিছিলে তাঁর ছিল উচ্চকণ্ঠ। বড়দের ভিড়ে সাহসের তকমা ছড়িয়েছেন। তিনি ছিলেন সাবেক পৌর চেয়ারম্যান, গণতন্ত্রী পার্টির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি।

চির সংগ্রামী, নির্লোভ এ কিংবদন্তি রাজনীতির কারণে সংসারী হননি। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে জীবনের দীর্ঘ সময় কারাবাস করেছেন। তিনি এখন নিজ বাড়িতে সম্পূর্ণ একা। বার্ধক্যের কারণে শরীর ভেঙে পড়েছে। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। চোখেও কম দেখেন। কখনো কখনো কানে ভালো শুনতেও পান না।

নগরীর মুন্সিপাড়ায় তাঁর বাড়িতে কথা হয় ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আফজালের সঙ্গে। বাড়ির একটি অংশ ছাত্রদের মেস ভাড়া দিয়েছেন। স্ত্রী-সন্তান না থাকায় দু-একজন নিকটাত্মীয় আর ভাড়াটিয়া ছাত্ররাই তাঁর দেখাশোনা করেন।

ভাষা সৈনিক আশরাফ হোসেন। রংপুরের মানুষের কাছে যিনি পরিচিতি ‘বড়দা’ নামে। তাঁর জীবনে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ার গল্পটা একটু ভিন্ন। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি প্রবন্ধ পড়ে ভাষা আন্দোলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ হন তিনি। প্রগতিশীল শিক্ষক স্যার সন্তোষ গুহ ও কবি শাহ আমানত আলীর কাছে পেয়েছিলেন প্রাণের ভাষা বাংলার জন্য অনুপ্রেরণা।

আশরাফ হোসেন জানান, ১৯৫২ সালে তিনি লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তখন থেকে লালমনিরহাটের আবুল হোসেন, শামছুল হক, আনিছুল হক, ষষ্ঠী সরকার, নাসির উদ্দিন, নাসিম আহমেদ, টুক চৌধুরীসহ অনেকের সঙ্গে মিছিলে শরিক হতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের খবর শুনে রংপুরের রাজপথে নামেন। সে সময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন।

আন্দোলনের কারণে ১৯৫৪ সালে আত্মগোপনে চলে যান আশরাফ হোসেন। ১৯৫৫ সাল থেকে রংপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে তিনি বয়সের ভাড়ে ন্যুয়ে পড়েছেন। কখনো লাঠিতে, নয়তো অন্যের হাত ধরে চলাফেরা করেন। কমেছে স্মৃতিশক্তিও। তবে ৬৭ বছর আগের ভাষা সংগ্রামের দিনগুলোর স্মৃতি স্মরণ করতে ভুল হয় না তাঁর।

শাহ্ তবিবর রহমান প্রধান। রংপুর মহানগরীর গুপ্তপাড়ার নিউক্রস রোডে তাঁর বাসা। সেখানেই অবসর জীবনযাপন করছেন। তিনিও বয়সের ভাড়ে ভারাক্রান্ত। ছাত্রাস্থায় তিনি ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন।

তাঁর নেতৃত্বে রংপুর জিলা স্কুল থেকে মিছিল বের হতো। ১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির রংপুরের বদরগঞ্জে এক বিশাল জনসভা হয়। তিনি ওই জনসভাতে বক্তৃতা করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় তবিবর রহমান জিলা স্কুলের দশম শ্রেণীতে পড়লেও ভাষার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিলেন অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায়। ভাষা সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার কারণে এক সময় তাকে কারমাইকেল কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।

১৯৪৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রংপুর কারমাইকেল কলেজে বিক্ষোভ মিছিল করেন ছাত্ররা। তখন থেকেই রংপুরে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন মীর আনিসুল হক পেয়ারা। বর্তমানে তাঁর বয়স ৮৩। চার বছর আগে জীবন সঙ্গীনি নুরজাহানের মৃত্যু হয়েছে। এরপর থেকে তিনি বড়ই একা হয়ে পড়েছেন। চার মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান রয়েছে তার।

আনিসুল হক পেয়ারা গত ছয় মাস ধরে চলাফেরা করতে পারছেন না। সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুত্বর আহত হওয়ার পর থেকে বিছানাকে সঙ্গী করে নিয়েছেন তিনি। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা আর দুর্ঘটনার ব্যথা তাড়া করছে তাকে। বাসা থেকে তেমন একটা বের হতে পারেন না। ছোট ছেলে মীর ইফতেখারুল হক পল্লবের স্ত্রী রাবেয়া খাতুন শিল্পী আর ছোট মেয়ে স্কুল শিক্ষক শাহিনা সুলতানা এখন শয্যাশয়ী মানুষটি ভরসা।

এই ভাষা সৈনিক বলেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে মিছিলে যাওয়ার জন্য রংপুর জিলা স্কুল থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয় আমাকে। পরে আদর্শ স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে ১৯৫২ সালে কারমাইকেল কলেজে ভর্তি হই। সেসময় কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন অবাঙালি অধ্যক্ষ শাহাবউদ্দিন ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না। ছাত্রদের মিছিল, সভা-সমাবেশ করতে দিতেন না উর্দুভাষী ওই অধ্যক্ষ। কোথাও কোনো পোস্টার দেখলেই ছিঁড়ে ফেলার কিংবা দেয়াল লিখন দেখলে মুছে ফেলার নির্দেশ দিতেন। কিন্তু ছাত্রদের কোনোভাবেই দমাতে পারেনি কলেজ প্রশাসন।

আনিসুল হক পেয়ারা বলেন, ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার কারণে ৫২’র পরে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। এক পর্যায়ে আত্মগোপনে চলে যাই। এ কারণে ১৯৫৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে পারিনি। পরে ১৯৫৫ সালে পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়। ১৯৫৬ সালে আবার আমাকে পলাতক হতে হয়। এরপর ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলনের সময় জেল খাটি দুই মাস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উর্বর ভূমি রংপুর। প্রাচীনতম এ জেলায় ভাষা আন্দোলনে নাম জানা, অজানা অসংখ্য মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। তাদের মধ্যে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন- লে. কর্নেল জাহিদুল হক চৌধুরী, শামসুল হুদা (আবু), অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম, সিদ্দিক হোসেন, ডা. রোকেয়া আলমগীর রুবি, কমরেড বিনয় সেন, মজিবর রহমান মতি মিয়া, ডা. শোভান খান, ডা. দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক (মন্টু ডাক্তার), মকবুল হোসেন, কানু ঘোষ, আফান উল্লাহ, মোসলেম আলী খান, ইব্রাহিম খান সুরুজ, ডা. কবির খান বখতিয়ারি, অ্যাডভোকেট গাজী রহমান, কামরান শাহ আবদুল আউয়াল, অধ্যাপক রেজা শাহ তৌফিকুর রহমান, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, তোজাম্মেল আলী, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী, শাহ আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ আফজাল, আশরাফ হোসেন বড়দা, শাহ্ তবিবর রহমান প্রধান, মীর আনিসুল হক পেয়ারা, তনসিম উদ্দিন আহমেদ মনু ও পানার উদ্দিনসহ আরও অনেকেই।

ভাষা আন্দোলনে রংপুরের ছাত্র-জনতার মধ্যে সমন্বয় আনতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল ভাষা সৈনিক শাহ তোফাজ্জল। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছিলেন ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘কমিটি অব অ্যাকশন’ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকেসহ অনেককেই পাঠিয়ে দেওয়া হয় রংপুর।

শাহ তোফাজ্জলসহ রংপুরের সাবেক মন্ত্রী মরহুম মতিউর রহমান, অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান, ইয়াকুব আলী, মাহফুজ আলী, কাজী মুহাম্মদ এহিয়া, মণি কৃষ্ণ সেন, শংকর বসু, শাহ আবদুল বারী, ধীরেন ভট্টাচার্য, জীতেন্দ্রনাথ দত্ত, ইদ্রিস লোহানী, সুফী মোতাহার হোসেন, কছিম উদ্দিন, আমজাদ হোসেন, আজমল হোসেন, আবুল হোসেন, ডা. মোজাহার উদ্দিন, ডা. আবতাব উদ্দীন তালুকদার, ভিখু চৌধুরী, শাহ আবদুল বারী, অ্যাডভোকেট নুরুল হক, দবির উদ্দিন আহম্মদ, খয়রাত হোসেন, নাজিম খন্দকার, মোহাম্মদ আফজাল, আজিজার রহমান, নাজমুল আলম চৌধুরী হেবিন, মতিয়ার রহমান, আজিজুল হক সেলিম, আবদুস সোবহান, কৃষক নেতা দরাজ আলী ও শাহ তবিবর রহমান প্রধান তখন রংপুরের আন্দোলনে পুরোধা হিসেবে কাজ করেছেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর