মানসিক ভারসাম্যহীন যুবকটি ফিরে পেলেন তার পরিবার

ময়মনসিংহ, জাতীয়

উবায়দুল হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ময়মনসিংহ, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 18:46:38

ঘটনাটি যেন সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। ৪ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের সন্ধান পেয়ে ছুটে এসেছেন বোন। মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও এত বছর পরও ঠিকই বোনকে চিনতে পেরেছেন সোহেল। ভাইকে সামনে পেয়ে বোনও যেন বাকরুদ্ধ। ভাই বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন এমন চিন্তায় যাদের দিন যেত তারাই কিনা দীর্ঘ ৪ বছর পর ভাইয়ের দেখা পেলেন। তাইতো হাতটি ধরে স্তব্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে ভাইকে মনভরে দেখছিলেন বোন। সেই তাকানোতে ছিল একধরণের অবিশ্বাস, ভাইয়ের জন্য ভালোবাসা, মমতা আর ফিরে পাবার আনন্দ।

এমন দৃশ্যই শনিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে ময়মনসিংহের ২ নং পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) দেবাশীষ সাহার কক্ষে উপস্থিত সবাই লক্ষ্য করলেন।

এই ঘটনার একদিন আগের কথা। বৃহস্পতিবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় ওই এসআই ও যমুনা টিভির স্থানীয় সাংবাদিক হোসাইন শাহীদ মিলে জট পাকানো চুল, দাড়ি কেটে, গোসল ও নতুন পোশাক পড়িয়ে পাল্টে দিয়েছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন সোহেলকে (৩০)। তারপর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তার হাতের অস্ত্রোপচার করান তারা।

এ নিয়ে ভিডিওসহ বার্তা২৪.কম-এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তা মুহুর্তেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে সোহেলের পরিচয় ও তার পরিবারকে খুঁজে পেতে পুলিশের পাশাপাশি বার্তা২৪.কম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারণা চালায়। পুলিশের ও বার্তা২৪.কমের তৎপরতায় শুক্রবার সন্ধান পাওয়া যায় সোহেলের পরিবারের।

এদিকে, সোহেলের পরিবার আসতে আসতেই ঘটে যায় আরেক বিপত্তি। সন্ধ্যা থেকে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সোহেলকে। কাউকে কিছু না বলে নিরুদ্ধেশ হয়ে পড়েন তিনি আবারও। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ওইদিন রাত সাড়ে ১২ টার দিকে নগরীর জয়নুল উদ্যান সংলগ্ন ব্রহ্মপুত্র নদের পাড় থেকে সোহেলকে উদ্ধার করেন টহল পুলিশ।

পরদিন শনিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে তাকে নিতে ময়মনসিংহ আসেন বড় বোন মাহবুবা খান মায়া। তিনি বলেন, ‘ঝালকাঠি জেলা সদরের বাউলকান্দি গ্রামের নানা বাড়ি থাকতো সোহেল। ৪ বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে হারিয়ে যায় সে। তখনও মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। এরপর আমরা থানায় জিডিসহ অনেক খোঁজাখুজি করেও তার সন্ধান পাইনি।’

আবেগে আপ্লুত বোন বলেন, ‘ছোট ভাইয়ের বেঁচে থাকার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম আমরা। হঠাৎ ওই বিষয়টি ফেসবুকে আমার ভাবি দেখতে পেয়ে আমাকে জানায়। পরে ঝালকাঠি থানায় যোগাযোগ করে ভাইয়ের খোঁজ পাই। এরপরই তাকে নিতে আমার চাচাতো ভাই রিফাতকে সঙ্গে নিয়ে ময়মনসিংহ ছুটে আসি।’

পরিবারের কাছে সোহেলকে তুলে দিতে পেরে খুশি সেই পুলিশ কর্মকর্তা দেবাশীষ সাহাও। তিনি বলেন, ‘আসলে কাজটি মানবিক দায়িত্বেই করা। মানুষ হিসেবে বিপদগ্রস্থ একজন মানুষকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যেই এটি করেছি।’

এদিকে, পুলিশ-সাংবাদিকের মহানুভবতায় পাগলকে পাল্টে দেওয়ার খবর বার্তা২৪.কম-এ প্রকাশের পর বিষয়টি জানতে পারেন জেলা পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন। সোহেলকে তার স্বজনরা নিতে আসলে পুলিশ সুপার তাদেরকে ডেকে নেন তার কার্যালয়ে। আনুষ্ঠানিকভাবে সোহেলকে বুঝিয়ে দেন তার পরিবারের কাছে। একইসঙ্গে নগদ ১০ হাজার টাকাও তুলে দেন সোহেলের জন্য। এসময় সেই পুলিশ কর্মকর্তা এসআই দেবাশীষ সাহা ও সাংবাদিক হোসাইন শাহীদকে ধন্যবাদ ও এমন মহৎ কাজের প্রশংসাও করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘মানুষ যে এখনও সংবেদনশীল আচরণ করে এমনই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তারা। এজন্য আমি নিজেও গর্ব অনুভব করছি। এমন মহৎ কাজের জন্য আমি তাদের পুরস্কৃত করব, যেন অন্যরা উৎসাহিত হয়।’

সোহেলকে পরিবারের কাছে তুলে দিতে পেরে আনন্দিত সাংবাদিক হোসাইন শাহীদ। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে সব কিছুই যেন স্বপ্নের মতই মনে হয়েছে। মুহুর্তের মধ্যেই সবকিছু নাটকীয়ভাবে ঘটেছে। জীবনটা যে নাটকের চেয়েও নাটকীয় এমন ঘটনার মধ্য দিয়ে তাই মনে হয়েছে। শেষের মধুর দৃশ্য দেখে আনন্দে চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি আমরা কেউই।’

আরও পড়ুন: পুলিশ-সাংবাদিক মিলে পাল্টে দিলেন পাগলকে

এ সম্পর্কিত আরও খবর