গ্রীন বুক: বৈষম্যকে জয় করা ভালবাসার গল্প

ঢাকা, জাতীয়

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | 2023-08-31 05:41:21

মধ্যরাতের বৃষ্টিতে গাড়ি থামালো শ্বেতাঙ্গ পুলিশ। আফ্রিকান আমেরিকান ক্লাসিক্যাল এবং জাজ পিয়ানো বাদক ডন শার্লি পেছনে বসে আছেন। গাড়ির চালকের আসনে ইতালিয়ান আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ চালক টনি ভাল্লেলঙ্গা। এজন শ্বেতাঙ্গ, কালো মানুষের গাড়ি চালাচ্ছেন, এটা ১৯৬০ এর দশকে যেন কল্পনা করা যেতো না। অবজ্ঞা আর বৈষম্যের সুরে ‘শার্লি’কে কালো বলে গাল দিলেন পুলিশ অফিসার। মাথা যেন ঠিক রাখতে পারলেন না টনি। বিশাল বাহু ঘুরিয়ে ঘুসি বসিয়ে দিলেন পুলিশের মুখে।

ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। লকআপে নিয়ে যাওয়া হলো তাদের। রাত প্রায় গড়িয়ে যাচ্ছে। আমেরিকার আরেকটি প্রদেশে পরের দিন পিয়ানো বাজানোর কথা শার্লির। জেল খানায় বসে মুক্তির উপায় খুঁজছেন দুইজনই। বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ছেন টনি। তবে নিজের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলার অনুমতি চাইলেন শার্লি। ফোনে নিজের সমস্যার কথা জানালেন তিনি।

কিছুক্ষণের মধ্যে যেটা ঘটলো তার জন্যে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না স্টেশনের পুলিশ অফিসাররা। আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি’র ফোন। পুলিশ অফিসাররা না জানলেও ঠিকই জন এফ কেনেডি জানতেন আমেরিকার সবচেয়ে মেধাবী এই পিয়ানো বাদককে। ছাড়া পেয়ে টনির আরো মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। শার্লিকে বললেন, ‘তুমি এতোক্ষণ কেন বললে না যে জন.এফ. কেনেডি তোমাকে চেনেন!’

১৯৬২ সালে আমেরিকার সমাজের সাদা-কালোর বিভেদ আর সেখানে জমে ওঠা ভালবাসার গল্প নিয়ে সিনেমা তৈরি করেছেন পিটার ফ্যারিলি। গেলো জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ব্যাংককের এসএফ সিনেমা হলে দেখা হয়েছিল গ্রীন বুক। সবমিলিয়ে হলে আমরা দর্শক ছিলাম ৫ জন। ব্যাংককের যান্ত্রিক জীবনে ছুটির দিনগুলো ছাড়া হলে দর্শক হয় এমনই বললেন, আমার বন্ধু থাই পিবিএস এর সাংবাদিক কানালাউই ওয়াক্লেহং।

গত রোববার রাতে ৯১তম একাডেমী অ্যাওয়ার্ডে সেরা ছবি পুরস্কার জিতে নিয়েছে গ্রীন বুক। এবারের অস্কারে আলোচিত ছবি, ‘রোমা’, ‘এ স্টার ইজ বর্ন এবং ‘বোহেইমিয়ান রাপসোডি’র সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই সেরা ছবির অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছে, ‘বুক।’

নিউইয়র্কে ক্লাব যখন বন্ধ হয়ে যায়, টনির বাউন্সারের চাকরিও ছুটে যায়। কিছু আয়ের জন্যে সবসময় মুখিয়ে থাকলেও নিজের আত্মসন্মান বিসর্জন দেয়না টনি। তাই শার্লির প্রাসাদসম অভিজাত বাড়িতে যেয়েও নিচে বসতে রাজি হননি তিনি।

অন্যদিকে সাদা-কালো জাতিগত বিভেদে পড়ে নিজের অস্তিত্বে টানপোড়নে যাপিত হন শার্লি। শ্বেতাঙ্গদের  অনুষ্ঠানে যেমন তাকে বাথরুম করতে নিজের হোটেলে ফিরতে হতো, তেমনি আবার তার খাবারও বাইরে দেয়া হতো। আবার কৃষ্ণাঙ্গ সমাজেও তাকে দেখে সকলেই এড়িয়ে যেতো, কেননা তিনি শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে থাকতেন।

শার্লি নিজের বাসার কাজের লোক থেকে শুরু করে গাড়ির চালক এবং ব্যক্তিগত সহকারী সবখানেই শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি সব সময় বুঝিয়ে দিতেন যে তিনি মানুষ  এবং শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গের কোন পার্থক্য নেই। চালচলনে খুব অভিজাত্যের ছোঁয়া শার্লির। গাড়ির পেছনের সিটে বসলে শ্বেতাঙ্গ সহকারী পায়ের ওপর সাদা টাওয়েল বিছিয়ে দিতেন।

চালচলনে শার্লি এবং টনি দুজন মুদ্রার বিপরীত পার্শ্ব। টনি যেমন ফ্রাইড চিকেন খেতে পছন্দ করেন, অন্যদিকে শার্লি কখনোই মাংস ছুয়ে দেখেননি। টনি যেমন মুখে যা আসে তাই বলেন, তেমনি পরিকল্পনা ছাড়া একটি পদক্ষেপও দেন না শার্লি, কথা বলেন শুদ্ধ আর চমৎকার ভাষায়। আর কয়েক মাস জুড়ে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে তার পিয়ানো বাজানোর সময়সূচীর পরিকল্পনাটাই হচ্ছে  গ্রীন বুক।

দীর্ঘ ভ্রমণে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে থাকে। শার্লি যেমন ফ্রাইড চিকেনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তেমনি স্ত্রী লিন্ডা কার্দেলিনির কাছে চিঠি লেখার জন্যে সুন্দর সব কাব্যিক ভাষা ব্যবহার শুরু করেন টনি।

অস্কারে তিনটি ক্যাটাগরিতে নমিনেশনের মধ্যে তিনটিতেই পুরস্কৃত হয়েছে গ্রীন বুক। ড. ডন শার্লির চরিত্রে অভিনেতা মাহেরশালা আলী সেরা সহকারী অভিনেতার পুরস্কার গ্রহণ করেন। ফেরেলি, নিক ভাল্লেলঙ্গা এবং ব্রায়ান কারি  স্ক্রিন প্লে’র জন্য পুরস্কৃত হন।

নিউইয়র্ক টাইমসের রিভিউতে বলা হয়েছে, দুটি পুরুষের মধ্যে পথ চলতে চলতে একটি ভালবাসার গল্পের জন্ম হওয়া সত্যিই বিরল ঘটনা। যেখানে শার্লির কাছ থেকে টনি শিখতে পারে, কত সুন্দর করে স্ত্রীকে চিঠি লিখতে হয়। ধীরে ধীরে একজনের প্রতি আরেকজনের সন্মান তৈরী হয়। একজন আরেকজনকে ভালবাসতে শুরু করেন, কাজকে ভালবাসতে শুরু করেন।

এখন পর্যন্ত ১৪৪ মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করেছে ছবিটি। বৈষম্যকে দূর করতে ভালবাসার শক্তি যে কতটা কার্যকর সেটা দেখানো হয়েছে গ্রীন বুকে। সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার পরেও কাহিনীগুলো ঘুরতে থাকে মাথার ভেতর।

এ সম্পর্কিত আরও খবর