বুধবার (১৩ মার্চ) দুপুর ১২টার কাছাকাছি। মেয়র আব্বাস আলীর খোঁজে রাজশাহীর কাটাখালি পৌরসভা ভবনে গিয়ে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা। তাতেও সাড়া নেই। পরে পৌরভবন থেকে বেরিয়ে কাটাখালি বাজারে গিয়ে জানা গেলো, মেয়র মাসকাটাদীঘি স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিদর্শনে গেছেন। স্কুলের দ্বিতীয় ভবনের দিকে এগিয়ে যেতেই দরজার দিকে চোখ পড়লো। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলছেন মেয়র।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানালেন, পৌর মেয়র আব্বাস আলী এই স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি। প্রায় ১০বছর ধরে স্কুলের উন্নয়নে কাজ করছেন। তবে এজন্য অন্যের ওপর ভরসা করেন না তিনি। দিনের মধ্যে যখনই সময় পান ছুটে আসেন স্কুল আঙিনায়। নিজেই ক্লাসরুমে গিয়ে গিয়ে খোঁজ নেন। জানতে চান কার কী সমস্যা।
বিশেষ করে বাবা-মা হারা এতিম শিক্ষার্থীদের অভিভাবক তিনি। কারও বাবা নেই, কারও আবার মা নেই। কারো বাবা-মার হয়তো সংসার টিকেনি, তাই আলাদা থাকেন। কিন্তু প্রিয় সন্তানের দায়িত্ব নেননি দু’জনের কেউই। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা এমন শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছেন আব্বাস আলী।
এমন এতিম শিশুদের একজন জান্নাতুল মীম। পড়ছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। বাড়ি মাসকাটাদীঘি। অসুস্থ হয়ে দেড় বছর আগে মারা গেছেন বাবা। পরিবারে আয় উপার্জনের মতো আর কেউ নেই। মা গৃহিণী। ফলে স্কুলের বিভিন্ন ফি দেওয়া ও ইউনিফর্ম কেনার কথা সে ভাবতেই পারে না!
সহপাঠীদের বেশির ভাগই স্কুলড্রেস পরে আসে। কিন্তু মীম আসে বাড়ির পোশাকেই। নেই প্রাইভেট পড়ার সুযোগও। আর দুপুরে টিফিনের সময় অন্যরা যখন দোকানের দিকে ছুটে, মীমের পা তখন থমকে যায় স্কুলের বারান্দায়। কারণ টাকার যোগান দেবে কে!
একই ক্লাসে পড়ে শ্যামপুর মধ্যপাড়ার নাবিলা ইয়াসমিন। তারও বাবা বেঁচে নেই। মরে যাওয়ায় বাবার জীবন হয়তো থেমে গেছে, কিন্তু ছোট্ট নাবিলার জীবনের পথ কেবল শুরু। একমাত্র মা-ই নাবিলার ভরসা। কিন্তু আয় নেই মায়ের। তাই মীমের মতই অবস্থা তারও।
কেবল মীম কিংবা নাবিলাই নয়, একই ক্লাসের এতিম শিশু সৈয়দ খালিদ বিন রাজ্জাক ও শাহরিয়ার ইসলাম তপুদের অবস্থাও এমনই। তবে তাদের পাশে অভিভাবক হয়ে দাঁড়িয়েছেন কাটাখালি পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী।
তিনি নিজেই ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে উপবৃত্তির জন্য নামে তালিকা তৈরি করেন। যাদের বাবা-মা নেই তাদের স্কুলড্রেস (ইউনিফর্ম) বানিয়ে দিয়েছেন। অসহায় ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার ব্যবস্থা করেছেন। কিনে দিয়েছেন খাতা কলমও।
মীম, নাবিলা, তপু ও রাজ্জাক জানায়, স্কুলের খরচ আর লেখাপড়া টাকা নিয়ে তাদের চিন্তা করতে হয় না। মেয়র সাহেবই তাদের সব দেন। ফলে ঠিকঠাক মতোই তারা পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারছে।
পরে স্কুলের অধ্যক্ষের কক্ষে গিয়ে দেখা গেল, ষষ্ঠ ১৬ জন এতিম শিশুকে সঙ্গে নিয়ে নাস্তা করছেন মেয়র। নিজহাতে তুলে খাওয়াচ্ছেন পেয়ারা, কলা, আঙুর, বিস্কুট আর কমলার কোয়া। প্রত্যেকের হাতে খাবার তুলে দিচ্ছেন আর জানতে চাইছেন, কার কী লাগবে?
কার কার স্কুলড্রেস এখনো বাকি আছে? কার প্রাইভেট শুরু হয়নি। এমন পরম মমতায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে শিশুরাও। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন মেয়র।
মাসকাটাদীঘিস্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আখতার হাসান জানান, এখানে প্রায় দেড় হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। এরই মধ্যে কেবল ষষ্ঠ শ্রেণিতেই ১৬ এতিম শিশু রয়েছে। আর গোটা স্কুলে এই সংখ্যা প্রায় ১০০। পৌর মেয়র আলাদাভাবে এদের সবার খোঁজ রাখছেন। তাদের অভাব পূরণ করে যাচ্ছেন। নিজের টাকা খরচ করেই তিনি এসব করেন।
স্কুলের এতিম শিশুদের তিনি বাবার স্নেহ দিয়ে আগলে রেখেছেন বলে জানান অধ্যক্ষ।
মেয়র আব্বাস আলী জানান, জনপ্রতিনিধি হিসেবে কেবল প্রকল্প আর উন্নয়ন নিয়েই ব্যস্ত থাকলে চলে না। সামাজিক দায়বদ্ধতাও রয়েছে। তাই একান্ত নিজের ইচ্ছেতেই তিনি এতিমদের দেখাশোনা ও লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, স্কুলের একপাশে ক্যান্টিন নির্মাণের কাজ চলছে। এই ক্যান্টিনে নামেমাত্র টাকায় শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হবে। তবে এতিমদের জন্য থাকবে বিশেষ ব্যবস্থা।
আব্বাস আলী বলেন, ‘এসব কাজের বিনিময়ে আমি কিছুই আশা করি না। কেবল এতিমরা লেখাপড়া শিখে বড় হবে। মানুষ হবে। এটুকুই প্রত্যাশা করি।’