বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে মুজিব বর্ষের প্রতিধ্বনি

ঢাকা, জাতীয়

রেজা-উদ্-দৌলাহ প্রধান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-08-31 23:24:14

১৭ মার্চ, বাঙালি জাতির জীবনে মহানন্দের একটি দিন। ১৯২০ সালের এই দিনে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার তত্কালীন গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়ায় সম্ভ্রান্ত শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ছোট্ট একটি শিশু। পিতা-মাতার চার কন্যা আর দুই পুত্রের সংসারে তিনি ছিলেন তৃতীয়। আদর করে মা-বাবা শিশুটির নাম রাখেন ‘খোকা’।

কালের পরিক্রমায় সেই খোকা হয়ে ওঠে নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালির ত্রাতা ও মুক্তির দিশারী। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সংগ্রাম, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে পরিণত বয়সে হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। এক রাজনৈতিক সংগ্রামবহুল জীবনের অধিকারী এই নেতা বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসাবে।

বছর ঘুরে আবার এসেছে ১৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মদিন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবস পালিত হচ্ছে। সরকারিভাবে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি ও রাজনৈতিক পর্যায়ে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। তবে আর দশটা জন্মদিনের চেয়ে ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও নতুন মাত্রা নিয়ে হাজির হয়েছে এবারের ১৭ মার্চ।

এমনিতে প্রতিবছর জাতির জনকের জন্মদিন উপলক্ষে ১৭ মার্চ জাতীয় শিশু দিবস এবং ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার দিনটিকে স্মরণ করে জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয়। তবে মহীরূহসম কোনো জাতীয় ব্যক্তির জন্মশতবর্ষ মানে আরও বিশেষ কিছু অবশ্যই; যা ইতিহাসে চিরস্থায়ী দাগ রেখে যেতে সক্ষম হয়। তাই আর মাত্র একটি বছরের অপেক্ষা।

আগামী বছর ২০২০ সালে জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী পূরণ হবে। আর তার পরের বছর ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী। এই দুই দিবসকে লক্ষ্য করে ২০২০-২১ সালকে মুজিব বর্ষ হিসেবে উদযাপন করে স্মরণীয় করে রাখতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। কারণ বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে যেমন বঙ্গবন্ধুকে চিন্তা করা যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিলে অর্থহীন হয়ে পড়ে বাংলাদেশও।

তাই মুজিব বর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত বছরব্যাপী নানা অনুষ্ঠান ও কর্মসূচি পালন করা হবে দেশজুড়ে। মুজিব বর্ষের আয়োজন ও কর্মসূচিগুলোকে জাঁকজমকপূর্ণ, আকর্ষণীয় ও আড়ম্বরপূর্ণ করতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে। এবারের জন্মদিন তাই মুজিব বর্ষের আগমেনের প্রতিধ্বনি নিয়ে সামনে এসেছে।

আজীবন সংগ্রামী শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, সর্বোপরি সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন। ৭ মার্চ ঢাকার ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে যে ভাষণ দেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তা হয়ে আছে চির অম্লান এক মাইলফলক হিসাবে। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক মনকাড়া ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথের মতো দীর্ঘকায় এই পুরুষের চলা-বলা, অঙ্গুলি হেলন, সবকিছুই ছিল নান্দনিক। তাঁর পুরো ব্যক্তিত্বই ছিল শৈল্পিক। বাঙালির ক্ষোভ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, অপমান, জেদ, অহং, সংযম, স্বপ্ন, প্রতিরোধ, সংকল্প; সবকিছুই এক অতুলনীয় অর্কেস্ট্রার মতো বেজে উঠতো তাঁর ব্যক্তিত্বে। বাঙালি জাতির সুর, রঙ, আনন্দ, বেদনার তিনি ছিলেন মূর্ত প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু। তিনি এবং কেবল তিনিই তাঁর বলিষ্ঠ, সুযোগ্য, সুদৃঢ়, অনমনীয়, অকুতোভয়, সর্বোপরি দূরদর্শী নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে পৌঁছে দিয়েছেন স্বাধীনতার সুবর্ণ তোরণে। এর পরের ইতিহাস সবার জানা এবং তা বিশ্ববাসীরও অজানা নয়। ভাষণটি ইতোমধ্যে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণের স্বীকৃতি পেয়েছে। কেবল একটি ভাষণ ‘ওয়ার্ল্ডস ডুকমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ও জাতির গৌরব বহির্বিশ্বে বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে।

একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। ১৭ মার্চ ১৯৭১ সাল। দলে দলে মানুষ আসত ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে এবং তাঁর দু’টো কথা শুনতে। সেদিন ছিল তাঁর ৫২তম জন্মদিন। বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে জন্মদিনের শুভেচ্ছা বিনিময়ের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জীবনে কখনও আমার জন্মদিন পালন করিনি। আপনারা আমার দেশের মানুষের অবস্থা জানেন, তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। যখন কেউ ভাবতে পারে না মরার কথা, তখনও তারা মরে। ... আমার জন্মদিন কী, মৃত্যুদিবসই-বা কী? আমার জীবনই-বা কী? মৃত্যুদিন আর জন্মদিন অতি গৌণভাবে এখানে অতিবাহিত হয়। আমার জনগণই আমার জীবন।'

সত্যিই যেন তাই! বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনটাই দিয়ে গেছেন বাংলার দুখি, মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য। তিনি পরাধীনতা, দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে পারলেও মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ছিল অধরা। তার আগেই পচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করে কিছু নরপিশাচ। তবে পিতা না পারলেও পিতার দেখানো পথে বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি, উন্নত জীবনের জন্য লড়াই সংগ্রামে লিপ্ত আছেন তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির পিতার আদর্শ বুকে নিয়ে, তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এখন নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ কর্মযজ্ঞ। বাস্তবায়িত হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ অন্তত ১০টি মেগা প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর কক্ষপথ ঘিরে। এসবই মাত্র কয়েক বছরে সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে।

এটাই যেন ছিল স্রষ্টার ইচ্ছা। জাতির জনকের জন্মশতবর্ষ তথা মুজিব বর্ষ উদযাপিত হতে যাচ্ছে তাঁরই কন্যার হাত ধরে। জাতির জনকের প্রজ্বলিত দীপ্ত শিখা তথা সমুজ্জ্বল আলো পৌঁছে যাক বাংলার ঘরে ঘরে, মাঠ-ঘাট প্রান্তরে, এই আমাদের প্রত্যাশা। মুজিব বর্ষের প্রতিধ্বনিতে আমারাও শুভেচ্ছা জানাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। শুভ জন্মদিন, বঙ্গবন্ধু।

এ সম্পর্কিত আরও খবর