নারী ফুটবলার তৈরির গ্রাম নয়াপুকুর

রংপুর, জাতীয়

ফরহাদুজ্জামান ফারুক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, রংপুর, বার্তা২৪.কম | 2023-12-20 20:03:05

ছোট ছোট দল বেধে মাঠে আসে ওরা। ভোরে কিংবা বিকেলে। গায়ে রঙিন জার্সি। হাতে ফুটবল। চলে কঠোর অনুশীলন। লক্ষ্য লাল-সবুজের পতাকাবাহী দলে জায়গা করে নেয়া।

 

ওরা পরিচয়ে নারী হলেও নিজেদের মানুষ ভেবে এগিয়ে যেতে চায় সামনে। এ কারণে অবহেলা, দারিদ্রতা বা সমাজের চোখ রাঙানি কিছুই দমাতে পারেনি ওদের। বরং অর্থনৈতিক-সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে ওরা ছুটছে ফুটবলকে সামনে রেখে।

২৬ জনের কিশোরী ফুটবল দলের অনেকেই ভালো খেলে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম কুড়িয়েছে। নিজেদের পরিচয় মেলে ধরার স্বপ্ন অর্জনে রেখেছে কৃতিত্বের স্বাক্ষর। অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা এই অদম্য ফুটবল কন্যাদের কারণে গ্রামে তৈরি হয়েছে সচেতনতা। নেই আগের মতো বাল্যবিয়ের হিড়িক।

রংপুর মহানগরী থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে সদ্যপুস্করণী ইউনিয়নের পালিচড়ার নয়াপুকুর এই ফুটবল কন্যাদের গ্রাম। এখান থেকে জাতীয় প্রমীলা ফুটবল দল সহ অনূর্ধ্ব ভিত্তিক দল ও বিভিন্ন ক্লাবে খেলছেন নয়জন। ওদের ফুটবল ম্যাজিকে নয়াপুকুর গ্রামটি এখন নারী ফুটবলারদের বাগান হিসেবে পরিচিত।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, পালিচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পালিচড়া এমএন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে অনুশীলন করছে অনেক মেয়ে। এক ঝাঁক সাহসী ফুটবল কন্যাদের এমন দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকেই দেখেন। কেউ কেউ হাত উঁচিয়ে সাহস বা তালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ছেলেদের ফুটবল যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে, তখন দেশবাসীকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে এই গ্রামের কিশোরী ফুটবলাররা। ২০১১ সালে প্রথম বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেসা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের মধ্য দিয়ে এ গ্রামের ৪০ জন ক্ষুদে কিশোরী ফুটবল খেলা শুরু করে। ওই বছরই পালিচড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নারী ফুটবলাররা রংপুর বিভাগের হয়ে নেতৃত্ব দিয়ে রানার্স আপ হয়। পরের বছরই দেশ সেরা ফুটবল দল হয় ওরা।

ইতোমধ্যে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়ন ও এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশীপে কৃতিত্বের জন্য গ্রামের সুলতানা, লাভলী, রত্নাসহ বেশ কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে আর্থিক সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছে। এরপর থেকে গ্রামের অনেক মেয়ে ফুটবলে আসতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। এখানকার স্বপ্না, রত্না, মৌসুমি, রুনা, রুমি, সুলতানা, বৃষ্টি, লাবণী, মৌরসী, আশা অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৫ ও অনূর্ধ্ব-১৪ দলের হয়ে খেলছে।

এর আগে দেশের বাইরে তাজিকিস্তানে এএফসি-অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবল প্রতিযোগিতায় চূড়ান্ত পর্বে বাংলাদেশ দল ভারতকে ৯-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জয়ী হয়। ওই দলে এ গ্রামেরই তিন ফুটবলার লাবণী আক্তার, আর্শিতা জাহান ও আঁখি আক্তার খেলেছে।

এই অদম্য কিশোরীদের শুরুতে ক্রীড়া সংগঠক শামীম খান মিসকিন ও ক্রীড়ানুরাগী আবেদ আলী ক্যাশিয়ার (প্রয়াত) অনুপ্রেরণা দেন। পরে স্থানীয় শিক্ষক হিটলার, ফুটবলার হারুন-অর-রশিদ তাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। ২০১৩ সালের শেষ দিক থেকে এখন পর্যন্ত স্থানীয় যুবক মিলন খান রাজ বিনা পারিশ্রমিকে এই ক্ষুদে কিশোরীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছেন।

অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় দলের সদস্য নুসরাত জাহান বৃষ্টি বলে, ‘আমার বড় বোন ইসরাত জাহান রত্না এবং আমি ফুটবল খেলছি। ভালো খেলে আমরা দেশ ও দলের জন্য কিছু করতে চাই। তবে খেলার জন্য বাড়ির বাইরে অনেকে বাজে মন্তব্য করে। সবকিছু সহ্য আর উপেক্ষা করে প্রতিদিন অনুশীলন করছি।’

আরেক ক্ষুদে ফুটবলার মৌরসী বলে, ‘আমাদের যে খেলার মাঠটি রয়েছে, তা ফুটবল খেলার উপযোগী না। উঁচু-নিচু হওয়ায় খেলতে অনেক সমস্যা হয়।’

খেলোয়াড় রুমি-রুনার বাবা হলেন রবিউল ইসলাম (৪৮)। ছোট হোটেল ব্যবসা করেন। মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে তাদের উৎসাহিত করেছেন। রবিউল ইসলাম বলেন, ‘সমাজে কে কি বলল, সেটা নিয়ে আমি ভাবি না। মেয়েরা ভালো খেলছে বলেই আজ এই গ্রামে সাংবাদিকরা আসে। আমাদের মেয়েদের খোঁজখবর নিচ্ছে। এটা যেমন গ্রামের অহংকার, তেমনি ওরা ভালো খেললে দেশেরও গৌরব।’

কিশোরী ফুটবলারদের কোচ মিলন খান রাজ বলেন, ‘সকাল ও বিকেলে তারা ওয়ার্ম আপ অ্যাক্টিভেশন, পাসিং প্র্যাকটিস, পজিশন গেম, গেম ট্রেনিং, ট্রেনিং গেম ও কুল ডাউন অনুশীলন করে। এছাড়া ফিটনেস ট্রেনিংও করানো হয়। আমাদের মেয়েদের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় তারা ঠিকমতো প্রশিক্ষণ নিতে পারে না। কারও জুতা, কারও জার্সির সমস্যা। তারপরও অদম্য কিশোরীরা কঠোর পরিশ্রম করছে।’

পালিচড়া এমএন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাজেদুল হক সাজু বলেন, ‘এই মেয়েরা বঙ্গমাতা ফুটবল খেলে পরপর দু’বার রানার্স আপ ও একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ২০১৮ সালে ৪৭তম গ্রীষ্মকালীন খেলায় দেশের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। এরা খুবই গরিব ঘরের মেয়ে। একটু সুযোগ-সুবিধা পেলে আরও ভালো করতে পারত।’

এসব সমস্যা পর্যায়ক্রমে সমাধানের আশ্বাস দিলেন জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা ফেরদৌস আলম। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের মধ্য দিয়ে অনেক প্রতিভাবান ক্ষুদে তারকা ফুটবলার বের হয়েছে। এদের পৃষ্ঠপোষকতা এবং জাতীয় পর্যায়ে আনতে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর