শিক্ষকের মেয়ের কাল শিক্ষকই!

ঢাকা, জাতীয়

মনি আচার্য্য, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 01:32:08

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার অগ্নিদগ্ধ মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির বাবা মওলানা একেএম মুসা একজন মাদরাসা শিক্ষক। তবে আরেক মাদরাসা শিক্ষক সিরাজ-উদ-দৌলা কাল হয়ে এল এই মাদরাসা ছাত্রীর জীবনে। ওই শিক্ষকের নির্দেশেই দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছে তাকে।

নুসরাতের বাবা মওলানা একেএম মুসা গত ১০-১২ বছর ধরে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার জামেয়া সরবতিয়া আলিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন। নিজ এলাকায় তিনি সম্মানীয় ব্যক্তি। তিন ছেলে ও একমাত্র মেয়ে নুসরাতকে সুশিক্ষিত করতে সব সময় সচেষ্ট ছিলেন তিনি। তারই দেখানো পথে ছেলে মেয়েরাও খুশি মনে মাদরাসায় শিক্ষাগ্রহণ শুরু করেন। বড় ছেলে ইতোমধ্যে ফাজিল পরীক্ষা দিয়েছেন, ছোট ছেলে পড়ছেন দাখিলে, মেঝ ছেলে মাদরাসার পড়াশোনা শেষ করে কুয়েত প্রবাসী, আর এক মাত্র মেয়ে নুসরাত আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। সুন্দর সাদামাটা সংসারে সবার প্রিয় ছিল নুসরাত। একমাত্র মেয়ে হওয়ায় সে মা-বাবার আদর যেমন পেতো, তেমনি তিন ভাইয়ের চোখের মনি ছিল।

সবকিছু ঠিক মতোই চলছিল। কিন্তু গত শনিবার (৬ এপ্রিল) এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মওলানা একেএম মুসার সাজানো সংসারে নেমে আসে ভয়াবহ অন্ধকার। নিজের কলিজার টুকরা একমাত্র মেয়ে নুসরাতের শরীরের কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বোরকা পরিহিত পাঁচজন পাষণ্ড। আর এই জঘন্যতম ও নেক্কারজনক ঘটনাটি ঘটানো হয় আরেক জন মাদরাসা শিক্ষকের নির্দেশে।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুরু থেকেই নুসরাতের ওপর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার কু-দৃষ্টি ছিল। কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ও থানায় অভিযোগ করায় অধ্যক্ষের নির্দেশে তার শরীরে আগুন দেওয়া হয়। পরে ওইদিনই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে আনা হয়। দীর্ঘ চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অবশেষে বুধবার (১০ এপ্রিল) মারা যান নুসরাত।

এ ঘটনার পর থেকেই ক্ষোভে ফুঁসছেন সারাদেশের মানুষ। সবার প্রশ্ন- কীভাবে শিক্ষকই আরেকজন শিক্ষকের মেয়ের (ছাত্রী) জীবনে কাল হলেন? এ ধরনের কাজে হতবাক দেশবাসী, নির্বাক স্থানীয়রাও। কেউই নুসরাতের অকাল চলে যাওয়া মানতে পারছেন না।

বৃহস্পতিবার ঢামেক হাসপাতালের মর্গের সামনে বার্তা২৪.কম-এর সঙ্গে কথা হয় নুসরাতের বাড়ির পাম্ববর্তী কয়েকজন প্রতিবেশীর সঙ্গে। এর মধ্যে মো. সাঈদুর রহমান বলেন, ‘২০ বছর ধরে মওলানা একেএম মুসার পরিবারকে জানি। মুসা ভাই এলাকায় যেমন সম্মানীয় ব্যক্তি, তার সন্তানদের আচার-আচরণও মার্জিত। আমরা প্রথমে এসব বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। একজন মাদরাসা শিক্ষক আরেক মাদরাসা শিক্ষকের মেয়ের এতো বড় সর্বনাশ কীভাবে করেন! এলাকায় সবাই ওই নরপিশাচ অধ্যক্ষকে ধিক্কার জানাচ্ছে।’

এ বিষয়ে নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু ও ঢাকা কলেজের সম্মান শ্রেণির তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ইউসুফ বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘মুসা চাচা ও তার পরিবারকে এলাকার মানুষ যে কতটা সম্মান ও শ্রদ্ধা করে তা এলাকায় না গেলে বোঝা যাবে না। নুসরাতও অনেক মেধাবী ছিল। নিজ মাদরাসার শিক্ষকের কারণে তার এই অকাল মৃত্যু হবে তা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না।’

এদিকে, ইউসুফের কথা শোনার পর নুসরাতের বড় ভাই নোমান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘নুসরাত শুধু আমাদের বোন না, সে আমাদের বন্ধুও ছিল। ঈদ বা যে কোনো অনুষ্ঠানে তাকে ভালো কিছু উপহার দেওয়াই আমাদের ভাইদের আনন্দ ছিল। কিন্তু এখন আমরা কাকে উপহার দেব? আমরা বোনকে তো আর খুঁজে পাব না।’

কান্না জর্জরিত কণ্ঠে নোমান দু’একটি কথা বলতে পারলেও কোনো কথাই বলতে পারেন নি নুসরাতের অরেক ভাই রায়হান। বোনের কথা মনে হলেই সে বার বার কান্না করছেন। আর ছেলের অবস্থা দেখে নির্বাক বাবা একেএম মুসা।

আরও পড়ুন: নুসরাতের চলে যাওয়া ও আমাদের দায়বদ্ধতা

এ সম্পর্কিত আরও খবর