রাজশাহীতেই অপরিচিত ‘শখের হাঁড়ি’!

রাজশাহী, জাতীয়

হাসান আদিব, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, রাজশাহী, বার্তা২৪.কম | 2023-09-01 23:30:37

প্রায় তিন যুগ ধরে রাজধানীসহ সারাদেশ মাতাচ্ছে রাজশাহীর বসন্তপুরের ‘শখের হাঁড়ি’। রাজশাহীর পালবাড়ির ৫৮ বছর বয়সী সুশান্ত কুমার পাল এই হাঁড়ি তৈরির প্রধান কারিগর। হাঁড়িগুলো মূলত বৈশাখী মেলাসহ বিভিন্ন মেলায় বিক্রি হতে দেখা যায়। কিন্তু রাজশাহীতেই অনেকেই চেনেন না এই শখের হাঁড়ি!

জানা গেছে, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে জাপানেও জনপ্রিয় এই শখের হাঁড়ি। দেশের প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে গিয়ে বড় অনুষ্ঠানে নিজের অভিজ্ঞতাও জানিয়ে এসেছেন সুশান্ত পাল। সেখানকার মানুষ ও গণমাধ্যমের কাছে পেয়েছেন সেরা উপাধি। এছাড়াও শখের হাঁড়ির গল্প যুক্ত হয়েছে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে। আরকারুশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদ, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, জাতীয় জাদুঘর, কারিকা বাংলাদেশ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনসহ(বিসিক) সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩২টি সনদ রয়েছে সুশান্ত পালের।

এক কথায় প্রাপ্তির কমতি নেই রাজশাহীর এই কারুশিল্পীর। তবে রাজশাহীতেই বেশ অপরিচিত এই শখের হাঁড়ি! বৈশাখেও রাজশাহীর বড় কোনো মেলায় দেখা মেলে না দেশ-বিদেশ মাতানো শখের হাঁড়ির। এ নিয়ে মনোকষ্ট রয়েছে সুশান্ত কুমার পালের।

গত শুক্রবার (১২ এপ্রিল) রাজশাহীর বসন্তপুরে সুশান্ত পালের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে রঙ করা হাঁড়িগুলো। তবে এখন আর হাঁড়ি বানানোর কাজ করা হচ্ছে না। চলছে রঙ তুলির শেষ আঁচড়।

সুশান্ত পালের স্ত্রী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘দুই ছেলেকে নিয়ে সুশান্ত পাল এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। সেখানে মেলায় অংশ নিতে দু’চালানে অসংখ্য শখের হাঁড়ি ও তৈজসপত্র নিয়ে চলে গেছেন। বাড়িতে যেগুলোর কাজ চলছে, সেগুলো স্থানীয়ভাবে বিক্রি করা হবে।’

এ ব্যাপারে শনিবার (১৩ এপ্রিল) মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে সুশান্ত পাল বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজশাহীর মানুষই শখের হাঁড়ি চেনেন না। অনেক আগে রাজশাহী বিসিক-এর নকশাবিদ আলাউদ্দিন সাহেব আমার শখের হাঁড়ি পছন্দ করেন। ওই সময় তিনি আমাকে বলেছিলন, আপনি ঢাকার বিজয়সরণীতে আসেন শখেরহাঁড়ি নিয়ে। বিক্রি না হলে আমি (আলাউদ্দিন) কিনে নেবে। সেই সময় একটা মেলা চলছিল। মেলায় সব শখের হাঁড়িগুলো বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে শুরু হলো গ্রামবাংলা থেকে ঢাকায় উঠে আসা শখের হাঁড়ির সুদিন।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদিও যুগ যুগ ধরে শখের হাঁড়ির স্থান করতে পারেনি রাজশাহীতে। রাজশাহীতে বিভিন্ন মেলা হয়। কিছু মেলায় কর্তৃপক্ষ অংশগ্রহণের বিষয়ে জানালেও পরে ডাকে না। তবে এই হাঁড়ি যে রাজশাহীতে চলবে না, এমনটি নয়।’

শখের হাঁড়ির এই কারিগর বলেন, ‘ঢাকায় আশার আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা, নগরীর উপকণ্ঠ খরখড়ি, নগরীর সাগরপাড়া রথের মেলায় অংশগ্রহণ করি। সেগুলোতে ব্যাপক সাড়া মেলেছে। কিন্তু জায়গার অভাবসহ বিভিন্ন কারণে বিস্তার ঘটানো সম্ভব হয়নি। গতবছর রাজশাহীর নিউ মার্কেট এলাকার থিম ওমর প্লাজায় বৈশাখী মেলায় অংশগ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু আয়োজকরা আর ডাকেনি।’

তিনি বলেন, ‘রাজশাহী দেশের মধ্যে শিক্ষানগরী হিসেবে খ্যাত। এই রাজশাহীতে আমার বাবা ভোলানাথ মাটির জিনিসপত্র বিক্রি করে আমাদের বড় করেছেন। এখানে শখের হাঁড়ি পরিচিতি ঘটানো এখন আমার স্বপ্ন। রাজশাহী জেলা প্রশাসকসহ সব মহল যদি এ নিয়ে উদ্যোগ নেন, তবে সহজেই আমরা রাজশাহীর মানুষের কাছেও ভালো জিনিস পৌঁছে দিতে পারব।’

পরবর্তী প্রজন্মের কে বা কারা তার শখের হাঁড়ি কিংবা মৃৎশিল্পের এই কারুকাজ ভালোভাবে রপ্ত করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সুশান্ত বলেন, ‘ছায়ে-পায়ে কুমার, বাপ-ব্যাটায় কামার, এর মানে হলো- দু’জন না হলে কামারের লোহা পিটিয়ে সোজা করা সম্ভব হয় না। আর ছেলে-মেয়ে-বউ, সবাই কাজে না লাগলে কুমারের কাজ করা যায় না।’

তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমার বড় ছেলে সঞ্জয় এবং ছোট ছেলে মৃত্যুঞ্জয়কে কাজটি শেখানোর চেষ্টা করছি। মেয়ে সুচিত্রা এবং দুই ছেলের বউও কাজ শিখেছে। ওরাও এখন মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে। আশা করি, যুগ যুগ ধরে বাপ-দাদার এই শিল্প বাঁচিয়ে রাখবে ওরাই।’

রাজশাহী জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমি সুশান্ত পালের বিষয়টি শুনেছি। কিন্তু তাকে কখনো দেখা হয়নি। তবে সরকার মৃৎশিল্প এবং কারুশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। আগামীতে সুশান্ত পালের তৈরি বিভিন্ন মাটির তৈজসপত্রের একক প্রদর্শনী করার মধ্য দিয়ে রাজশাহীর মানুষকেও এ বিষয়ে অবহিত করার চেষ্টা করব।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর