তীব্র দাবদাহে আমে বালাইয়ের উপদ্রব, লক্ষ্য পূরণে শঙ্কা

রাজশাহী, জাতীয়

হাসান আদিব, রাজশাহী, তারেক রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বার্তা২৪.কম | 2023-08-30 06:41:37

আমের জন্য বিখ্যাত উত্তরবঙ্গের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এ দুই জেলার আম দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয়। চলতি বছর আমের মৌসুমের শুরুতে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মুকুল ও কড়ি আসার লক্ষণ দেখে বাম্পার ফলনের আশায় স্বপ্ন বুনছিলেন এ অঞ্চলের আমচাষিরা। তবে তাদের সেই প্রত্যাশায় চিড় ধরাচ্ছে বৈশাখের তীব্র দাবদাহ।

এক সপ্তাহ ধরে রাজশাহীতে মৃদু, মাঝারি ও তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ২০১৬ সালের পর উত্তরাঞ্চলের তাপমাত্রা এবার ফের ৪২ ডিগ্রিতে উঠেছে। তীব্র এই গরম আমবাগানে বেড়েছে বিভিন্ন বালাইয়ের উপদ্রব। প্রখর রোদে পুড়ছে মাঝারি আকারের আম। বোটা শুকিয়ে যাওয়ায় ব্যাপক হারে ঝরে পড়ছে আম।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছর রাজশাহীতে রেকর্ড ১৭ হাজার ৪৬৫ হেক্টর জমিতে দুই লাখ ১৩ হাজার ৪২৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ৩২ হাজার হেক্টর জমির বাগান থেকে ৩ লাখ মেট্রিক টন আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

এদিকে, গত ৯ এপ্রিল রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসনের যৌথ সভায় হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী দুই জেলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের সমন্বয়ে ১৫টি পর্যবেক্ষক দল গঠন করা হয়। যাদের কাজ বাগানগুলোতে যাতে রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করা হয়, সেদিকে নজর রাখা। ফলে ১২ এপ্রিল থেকে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের নজরদারি থাকায় বাগানে ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারছেন না চাষিরা। ফলে আম উৎপাদনের রেকর্ড পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে ‘কেমিক্যাল ব্যবহারের’ কথিত ভয়।

আমচাষিরা বলছেন, গত এক সপ্তাহ ধরে প্রখর রোদ ও তীব্র গরমে আম শুকিয়ে যাচ্ছে। বোটা নরম হয়ে হালকা বাতাসে তা ঝরে পড়ছে। একই সঙ্গে গরমের কারণে বিভিন্ন ধরনের বালাইয়ের প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে। ফলে পাকার উপযোগী হওয়ার আগেই ব্যাপক হারে আম ঝরে পড়ার শঙ্কার কথা বলছেন চাষি ও বিশেষজ্ঞরা।

আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, হাইকোর্টের আদেশের কারণে সবার মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। কেউ চাইলেও কীটনাশক বা বালাইনাশক দিতে পারছে না।

বিষয়টি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে দাবি করে রাজশাহীর পুঠিয়ার কয়েকজন আমচাষি জানান, তারা বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে বালাইনাশক স্প্রে করা আর আম পাকানোর জন্য রাসায়নিক ব্যবহার করা আলাদা জিনিস। কিন্তু তা না বুঝেই প্রশাসন কোনো স্প্রে করতেই দিচ্ছে না। এতে এ অঞ্চলের আমের যে উৎপাদন ও ব্যবসা তাতে ভাটা পড়তে পারে বলে দাবি করেন তারা।

রাজশাহীর আমচাষি শহিদুল ইসলাম বলেন, গত তিন/চার বছরে রাজশাহী অঞ্চলে এবারের মতো এতো গরম পড়েনি। সূর্যের যে তাপ, তাতে মানুষ বাইরে বের হতে পারছে না। তাহলে আমের কী অবস্থা তা বুঝতেই পারছেন!

তিনি বলেন, গরমে পোকামাকড় বেশি হয়। দ্রুত তা বাগানে ছড়িয়ে পড়ে। মৌসুমের শুরু থেকে যতো যত্নই করা হোক, হঠাৎ পোকা লাগলে সব শেষ হয়ে যায়। তখন স্প্রে করেও তা ঠেকানো যায় না।

বানেশ্বর এলাকার আম ব্যবাসয়ী রাজেকুল ইসলাম এবার সাড়ে চার বিঘা বাগান লিজ নিয়েছেন। তিনি বলেন, কীটনাশক দিয়ে আম পাকানো হয় না, পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচানো হয়। কখন রাসায়নিক ব্যবহার করে আম পাকানো হয়, তা না বুঝে আদালতে ভুলভাবে রিট করে আমচাষিদের ক্ষতি ডেকে আনা হয়েছে। এতে দেশেরও ক্ষতি হবে।

রাজশাহীর মোহনপুরের আমচাষি সিরাজুল বলেন, হাইকোর্ট থেকে নির্দেশনার পর প্রায়ই বাগানে পুলিশ আসে। ধমক দিয়ে যায়, যাতে গাছে বিষ না দেই। কিন্তু স্প্রে না করলে কীভাবে এই রোদ আর গরমে পোকামাকড়ের হাত থেকে আম বাঁচাবো। সব তো নষ্ট হয়ে যাবে।

চাঁপাইয়ের শিবগঞ্জের আমচাষি শাকিল হোসেন বলেন, ‘আমাদের আম দেরিতে পাকে। ক্ষীরসাপাত, ল্যাংড়া, ফজলি আম পাকতে এখনও দেড় থেকে দুই মাস লাগবে। আম পাকার উপযোগী না হওয়া পর্যন্ত পোকামাকড়ের উপদ্রব থাকবেই।

তিনি বলেন, ‘আম যতো পুষ্ট হচ্ছে, এক ধরনের কাটাপোকা ভেতরে ঢুকে গর্ত করে ফেলছে। গরম বেশি পড়লে এই পোকার আক্রমণও বেড়ে যায়। এখন যদি আমরা বালাইনাশক ব্যবহার না করি, তাহলে যে আম গাছে এসেছে; তা আর কিছুই ভালো থাকবে না।’

কানসাটের শ্যামপুর এলাকার কাইয়ুম হোসেন বলেন, অপুষ্ট আম হলুদ রঙের করে বাজারে বিক্রির জন্য একটি গোষ্ঠী চেষ্টা করে থাকে। সেটা আম বাগানে করা হয় না, আড়তে ব্যবসায়ীরা করে থাকেন। আমে ফরমালিন ব্যবহার ঠেকাতে বাগানে পুলিশ না পাঠিয়ে রাসায়নিক দ্রব্য বা বিশেষ জাতীয় হরমোন বিক্রি বন্ধে অভিযান চালালে বেশি ভালো হবে।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দিন বার্তা২৪.কমকে বলেন, উত্তরাঞ্চলে গত এক সপ্তাহ ধরে তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রির নিচে নামছে না। দিনের বেলায় প্রখর রোদ পড়ছে। যাতে আমে বিভিন্ন প্রকারের বালাই উপদ্রব দেখা যাচ্ছে। এছাড়া বৃষ্টি না হওয়ায় আমের বোটা শুকিয়ে নরম হয়ে পড়ছে। ফলে আম ঝরছে।

তিনি বলেন, গরমের কারণে যে সমস্যা হচ্ছে, তা থেকে আম বাঁচাতে স্প্রে করা জরুরি। বিভিন্ন ভিটামিন জাতীয় ওষুধের সঙ্গে কীটনাশক বা বালাইনাশক দিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে। কিছু বালাইনাশক রয়েছে, যেগুলো আম বাগান থেকে নামানোর ১২/১৫ দিন আগে না দিলে কোনো ক্ষতি হয় না। সেগুলো দিলে কোনো আপত্তি নেই।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ উদ্যানতত্বের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, বালাইনাশক ব্যবহার আর ফরমালিন ছিটিয়ে আম পাকানো এক বিষয় নয়। আম সংগ্রহের দুই সপ্তাহ আগে বালাইনাশক ব্যবহার করলেও কোনো ক্ষতিকর প্রভাব খাওয়ার জন্য উপযোগী আমে থাকে না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রশাসক এসএম আব্দুল কাদের বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ১৫টি পর্যবেক্ষক টিম গঠন করেছি। তারা বাগানগুলোতে নজরদারি করছে। কৃষি অধিদপ্তর যে বালাইনাশক ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে, তা কোনো চাষি বাগানে ব্যবহার করলে আপত্তি নেই। বাগানমালিকরা নির্ভয়ে সেসব বালাইনাশক ব্যবহার করতে পারেন। তবে ক্ষতিকর কোনো রাসায়ানিক বা ফরমালিন যাতে ব্যবহার না করা হয়, সেদিকে নজর রাখছে প্রশাসন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর