দ্বৈত নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘসূত্রতা নিম্ন আদালতে : টিআইবি

, জাতীয়

সেন্ট্রাল ডেস্ক ২ | 2023-08-24 22:27:28

নিম্ন আদালতের ওপর সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান থাকায় প্রশাসনিক কাজে দীর্ঘসূত্রতা,দ্বন্দ্ব সৃষ্টিসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে বলে মনে করছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সম্প্রতি সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে নিয়ে উচ্চ আদালতে সৃষ্টি হওয়া অস্থিরতা নি¤œ আদালতের ওপরও প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছে তারা। এতে বর্তমানে দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে বলে মনে করে সংস্থাটি। একই সঙ্গে নি¤œ আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করার সুপারিশ করে টিআইবি। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ধানম-িতে টিআইবি’র প্রধান কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশের অধস্তন আদালত ব্যবস্থা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উপস্থাপনকালে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নি¤œ আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান সংক্রান্ত জটিলতার কারণে সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, দ্বৈত প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হচ্ছে। নিম্ন আদালত সংক্রান্ত কোনো উদ্যোগ বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে কিছু ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ বা দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দেওয়ার পরও মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করেছে। উদাহরণ হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রেষণে কর্মরত বিচারিক কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণে যাওয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয় গবেষণা প্রতিবেদনটিতে। টিআইবি’র এ গবেষণা প্রতিবেদন তৈরিতে দেশের ১৮টি জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। মুখ্য তথ্যদাতা ও নিবিড় সাক্ষাৎকারদাতারা হলেন নি¤œ আদালতের বিভিন্ন পর্যায়ের বিচারক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী, আইনজীবীদের সহকারী, জেলা আইন সহায়তা কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, এনজিও প্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী ও অন্যরা। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবি’র রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাম্মী লায়লা ইসলাম ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ১৮ জেলার ৬২১টি আদালতে ১১৪ জন বিচারকের পদ শূন্য রয়েছে। বিচারকদের বদলি বা অবসরের কারণে শূন্য হওয়া ওই পদগুলোতে নতুন বিচারক পদায়ন করা হয়নি। এছাড়া বিচারকদের প্রশিক্ষণ ও মাতৃত্বকালীন ছুটির কারণে কিছু পদ খালি রয়েছে। একইসঙ্গে এসব জেলা আদালতে ৫৭৯ জন সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদও শূন্য রয়েছে। বিচারকের শূন্যপদে একজন বিচারককে ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে সেইসব বিচারককে একাধিক আদালতে কাজ করতে হচ্ছে। নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের কারণে যথাযথভাবে কর্মসম্পাদন করা কঠিন হয়ে পড়ে তার জন্য। এ বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ‘বাংলাদেশের নিম্ন আদালত ব্যবস্থা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা পরিচালনা করে টিআইবি। দেশের ৮টি বিভাগের প্রতিটি থেকে দুটি করে মোট ১৬টি জেলা ও দুটি বিভাগ থেকে বিশেষ বিবেচনায় অতিরিক্ত আরও দুটি জেলা যুক্ত করা হয় এ গবেষণায়। মোট ১৮টি জেলার ৪৩৭ জন অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে গবেষণা প্রতিবেদনটি করা হয়েছে। গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১০ লাখ মানুষের জন্য গড়ে মাত্র ১০ জন বিচারক রয়েছেন। দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে বিপুলসংখ্যক মামলা চলমান রয়েছে। প্রতিদিন এই সংখ্যা বেড়েই চলছে। এসব মামলা পরিচালনার জন্য সার্বিকভাবে নিম্ন আদালতগুলোতে পর্যাপ্ত জনবলের স্বল্পতা রয়েছে। মামলার সংখ্যার তুলনায় বিচারকের ঘাটতি রয়েছে। কাজের চাপের তুলনায় অন্যান্য সহায়ক কর্মচারীর সংখ্যাও অপ্রতুল। মামলার সংখা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে জনবলের সংখ্যা সেই হারে বাড়েনি। আবার সময়ের চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আদালত সৃষ্টি করা হলেও সেগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। বিচারকদের সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদও খালি থাকায় আদালতের কাজে ধীরগতি থাকছে বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, আদালতগুলোতে মামলার সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু মামলা বৃদ্ধির সঙ্গে কর্মচারীর সংখ্যা বাড়েনি। জনবল কম থাকায় সব পর্যায়ে কাজের চাপ বৃদ্ধি পায় ও কিছু ক্ষেত্রে ধীরগতি আসে। গবেষণার আওতাভুক্ত ১৮টি জেলার আদালতে বিচারক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘাটতির পাশাপাশি অবকাঠামোগত, আর্থিক, প্রশিক্ষণ, অভিযোগ ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালনে অবহেলা, প্রতারণা ও জালিয়াতি, ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেন, প্রভাব বিস্তার ও অন্যান্য চাপ রয়েছে এসব আদালতে। গবেষণায় এসব অনিয়ম ও ঘাটতি উঠে আসার পরও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে মন্তব্য করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তবে আরও ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আদালতগুলোতে বিচারকের ঘাটতি প্রসঙ্গে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশে গড়ে দেড় লাখ মানুষের জন্য আছেন একজন বিচারক। এ চিত্র বিশ্বে বিরল। বিচারক কম থাকায় বিচারে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়।’ টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়েরসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা প্রতিবেদন উপস্থান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

এ সম্পর্কিত আরও খবর