আমার সিএনজি ‘মানতি স্যার’

ঢাকা, জাতীয়

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা, রাঙ্গামাটি থেকে ফিরে | 2023-08-29 18:54:38

সিএনজি চালিত অটোরিকশায় রাঙ্গামাটি শহরে ঢুকছিলাম। বনরূপা (শহরের প্রাণকেন্দ্র) এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যাল দিলেন অটোরিকশা থামানোর জন্য। গতি খুব একটা ছিল না, চালক চলন্ত অবস্থায় বলে দিলেন, ‘মানতি স্যার’।

ট্রাফিক পুলিশ আর কিছুই বললেন না। যথারীতি এগিয়ে যেতে থাকলাম। মনের মধ্যেই নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল, চালকের কাছে জানতে চাইলাম, পুলিশকে কী বললেন? জবাব দিলেন, ‘মানতি। আমার অটোরিকশা মানতি করা। না হলে শহরে যতবার ঢুকব ততবার ১শ’ টাকা করে দিতে হবে।’ তখন বুঝলাম, ইংরেজি মান্থলি মানে মাসিক শব্দের স্থানীয় সংস্করণ মানতি।

আবার প্রশ্ন করলাম, হাজার হাজার অটোরিকশা চলাচল করে, যদি মানতি করা না থাকলেও কেউ মানতি বলে! তাহলে বুঝবে কী করে?’ চালক জানালেন, ‘তা হওয়ার সুযোগ নেই। ওদের কাছে সবার তালিকা আছে। আবার বিট ভাগ করা আছে, সন্দেহ হলে বিটের অফিসার সার্জেন্টের নাম জানতে চাইবে। মাসে কত টাকা দিতে হয়? জবাব পাওয়া গেল, ‘২৫০ টাকা।’

আর কোথায় কোথায় এমন টাকা দিতে হয়? ‘সব জায়গায় দিতে হয়, না হলে সেই থানা এলাকায় প্রবেশ করা যায় না,’ বলেন তিনি।

কাপ্তাই লিচু বাগান এলাকার এই চালককে জ্বালানি (সিএনজি) ভরার জন্য যেতে হয় চট্টগ্রাম শহরে। কাপ্তাই রাস্তায় মাথায় অবস্থিত একটি সিএনজি ফিলিং স্টেশন থেকে গ্যাস ভরেন। এ কারণে হাইওয়ে কাপ্তাই রাস্তার মাথায় হাইওয়ে পুলিশকে মাসে দিতে হয় ৫শ’ টাকা।

যেহেতু চট্টগ্রাম যাওয়া আসার জন্য রাঙ্গুনিয়া এলাকার ওপর দিয়ে যেতে হয়, এজন্য রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশকে দিতে হয় ৩শ’ টাকা করে। রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশ এই মাসোহারা আদায় অনেকটাই আধুনিকায়ন করেছে। বিআরটিএ যেভাবে স্বচ্ছ ট্যাক্স টোকেন দেয় গাড়ির গ্লাসে লাগানোর জন্য। রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশও এমন স্বচ্ছ টোকেন চালু করেছে। যা গাড়ির কাঁচে প্রদর্শন করতে হয়।

অধিকাংশ অটোরিকশায় এই টোকেন লক্ষ্যণীয়। এতে তেমন কিছুই লেখা নেই। শুধু থাকে মাসের নাম ও নিচে সন। প্রতি মাসে টাকা দিয়ে এই টোকেন সংগ্রহ করে গাড়ির গ্লাসে লাগিয়ে রাখতে হয়। কোনো মাসে টাকা দিতে দেরি হলেই আর রক্ষে নেই। সোজা মামলা দিয়ে দেয়। আবার কখনও কখনও গাড়িও আটকে দেওয়া হয়। খুব কম চালকই আছেন যারা দৈনিক ভিত্তিতে টাকা দেন।

টাকা দিতে হয় নোয়াপাড়াতেও। এখানে মাসে ৩শ’ টাকা হারে দিতে হয়। সবচেয়ে কম মাসোহারা কাপ্তাই থানা পুলিশের। সিএনজি চালিত অটোরিকশা থেকে মাসে দেড়শ’ টাকা আদায় করছে হ্রদের পেটে থাকা এই থানা পুলিশ। মাসোহারা যথা সময়ে না দিলেই মামলা, গাড়ি আটকসহ নানা রকম হয়রানির শিকার হতে হয়। শুধু জরিমানার টাকা দিয়ে এই মামলা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। ৫শ’ টাকার মামলা দিলেও ৭ হাজার টাকা দিতে হয় বলে অভিযোগ করেন ওই চালক।

পুলিশ ধরলে মামলা, জরিমানায় রক্ষা পেলেও শান্তি বাহিনীর থেকে ছাড় পাচ্ছেন না চালকরা। শান্তি বাহিনীকে মাসে ১ হাজার টাকা করে দিতে হয়। না হলে দুনিয়া থেকে গায়েব করে দেওয়া হতে পারে। এখানে পুলিশও নাকি শান্তি বাহিনীকে সমীহ করে চলে।

ওই অটোরিকশা চালক বলেন, `ছোট-বড় কোনো গাড়িই টাকা না দিয়ে চলতে পারে না। সবাইকে টাকা দিতে হয়। ছোটো গাড়ির কম, বড় গাড়ির বেশি মাসোহারা। অর্থাৎ সব ধরনের যানবাহন থেকে এই টাকা আদায় করা হচ্ছে। সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র সড়ক রয়েছে নাটোরে, যেটি চলন বিলের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। এই সড়কটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে টোল দিয়ে চলাচল করতে হয়। কিন্তু অটোরিকশা চালকের কথায় মনে হচ্ছে, সারা দেশের প্রায় সব সড়কেই নিরবে চাঁদাবাজি চলছে। কয়েকদিন আগে রাজধানীর মাংস বিক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, ‘চাঁদাবাজি বন্ধ হলে নাকি ৩শ’ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি করা সম্ভব।’

এ সম্পর্কিত আরও খবর