মাত্র ৮ মাসের মেয়র আতিক!

ঢাকা, জাতীয়

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2023-08-30 12:06:01

মেয়র আতিকের কার্যকাল আর রয়েছে মাত্র ৮ মাস। দায়িত্ব নেওয়ার পর গতকয়েক মাসে কার্যত তিনি দৃশ্যমান কিছুই করতে পারেননি। অবশ্য এই কয়েকমাসে সব সময় তার মুখে উচ্চারিত হয়েছে আশ্বাসের ‘ফুলঝুড়ি’।

আতিকুল ইসলাম যার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সেই আনিসুল হক ছিলেন আপদমস্তক এক মেয়র। যা পারবেন তাই আশ্বাস দিতেন এবং কার্যকর করতেন।


রাজধানীবাসীর সেবার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা সিটি করপোরেশনকে উত্তর-দক্ষিণ দুইভাগে ভাগ করা হয়। শুরুতে এই বিভক্ত সিটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও পরে অবশ্য মানিয়ে নিয়েছে নগরবাসী ও বিশিষ্ট জনেরা। বিভক্তির প্রায় ৪ বছর পর দুই সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুই মেয়র আনিসুল হক ও মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বিজয়ী হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে দায়িত্ব গ্রহণের পর উত্তর সিটির প্রতিটি ওয়ার্ড চষে বেড়ানো শুরু করেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। নগরবাসীকে সবুজ ঢাকা মানবিক ঢাকা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে কাজ শুরু করেন। সেই পথ অনেক দূর এগিয়ে যান মেয়র। ৫ বছরের দায়িত্ব নিয়ে দুই বছরের মাথায় নগরবাসী হারায় মেয়র আনিসুল হককে। কিন্তু ওই দুই বছরের কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করার জন্য এখনো মানুষের মাঝে আনিসুল হকের স্বপ্ন উঁকি দেয়। কেউ কেউ বলেন মেয়র আনিসুল হক থাকলে উত্তর সিটি এতদিন সত্যি বদলে যেত।

দায়িত্ব গ্রহণের পর একটা একটা করে জঞ্জাল পরিষ্কার করতে নামেন মেয়র আনিসুল হক। তেজগাঁও থেকে ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে নগরবাসীর জন্য রাস্তা উন্মুক্ত করতে যেয়ে জীবন হুমকির মুখে পড়লেও পিছপা হননি মেয়র। এরপর বনানীতে যুদ্ধাপরাধী মোনায়েম খানের দখলকৃত জায়গা উচ্ছেদ করে রাস্তা করে দেন। কূটনৈতিক পাড়ায় প্রতিটি দূতাবাসের সামনের ফুটপাত দখলমুক্ত করে পথচারীদের কাছে ফিরিয়ে দেন। এরকম অনেকগুলো কাজ করে সবার স্বপ্নের মেয়রে পরিণত হন আনিসুল হক। লন্ডনের ওয়েলিংটন হাসপাতালে  চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নেন স্বপ্নবাজ সেই মেয়র।

দীর্ঘদিন তার যোগ্য উত্তরসূরি খুঁজতে থাকে সরকার। এরপর ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটিতে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী হিসেবে অনেকটা ফাঁকা মাঠে বিজয়ী হয় হন আরেক ব্যবসায়ী নেতা মো. আতিকুল ইসলাম। বিজয়ী হওয়ার পর চলতি বছরের ৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কাছে শপথ নেন আতিকুল ইসলাম। শপথ গ্রহণের পর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল ১২ মার্চ। প্রথম দিনেই যান উত্তরা শায়েস্তা খান এভিনিউ, আশকোনা সড়ক, বনানীর মেট্রোরেল প্রকল্পের পাশের খাল এবং বাড্ডার সুতি খাল পরিদর্শনে।


সেদিন পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমে স্বীকার করেছিলেন ওই এলাকার খাল দখল হয়ে গেছে। আমি এলাকাবাসীকে কথা দিয়েছি যারা দখলে নিয়েছে তারা নিজ উদ্যোগে না সরালে আমি উচ্ছেদ করব। আমি কথায় না কাজে প্রমাণ দিতে চাই, আমি ৭ দিন পর আবার পরিদর্শন করব। সেই ৭ দিনের জায়গায় চার মাস চলে গেলেও আর পরিদর্শন হয়নি মেয়রের।


এ বিষয়ে মেয়রের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, ওখানকার কাউন্সিলর আমাকে জানিয়েছেন খালের সমস্যা কিছুটা দূর হয়েছে, তাই যাওয়া হয়নি। এটা তো একটা উদাহরণ। বাসের চাপায় পিষ্ট হয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার নিহত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামাতে কথা দিয়েছিলেন দুই মাসের মধ্যে আবরার যেখানে নিহত হয়েছেন সেখানে একটি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করে দেওয়া হবে। দুই মাসের জায়গায় চার মাস গেলেও সম্পন্ন হয়নি ব্রিজ নির্মাণ। সবশেষ ঈদুল ফিতরের সরকারি ছুটির আগের দিন বসুন্ধরা গেটের সামনের ওই ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ কাজ এবং এলাকা পরিদর্শন করে প্রকৌশল বিভাগ ও ডিএনসিসি’র কর্মকর্তাদের কথা অনুযায়ী মেয়র বলেন কাজ করতে এসে টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দিয়েছে তাই সময় একটু বেশি লাগছে।


ছাত্র আন্দোলনের সময় মেয়র আতিকুল ইসলাম কথা দিয়েছিলেন খুব শিগগিরিই মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে প্রগতি সরণি পর্যন্ত সড়কটিকে ‘মডেল সড়ক’ হিসেবে নির্মাণ করা হবে। সেই সিদ্ধান্তও আলোর মুখ দেখা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ডিএনসিসি’র প্রকৌশল বিভাগের দাবি ওখানে এমআরটি’র কাজ হবে তাই বাস্তবে করা যাবে কি না চিন্তা করা হচ্ছে।


তার নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা। ক্যাম্পেইনে বিভিন্ন সভা সমাবেশে বলছিলেন আমি নগরবাসীর অভিযোগ শুনতে ‘নগরঅ্যাপ’ সেবা চালু করব। যদিও এই অ্যাপ আনিসুল হক চালু করেছিলেন। সেখানে অভিযোগ দিয়ে তার সমাধানও মিলত। তবে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ না করায় সেটি আর স্থায়ীরূপ লাভ করেনি বলে দাবি ডিএনসিসি’র। বাস্তবতা হচ্ছে ওই অ্যাপ চালু থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সার্বক্ষণিক তৎপর থাকতে হত। অথচ সেই নগরঅ্যাপ এখনও চালু করতে পারেননি মেয়র আতিকুল ইসলাম।


ডিএনসিসি’র অধিকাংশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশে না করার শর্তে বার্তা২৪.কম-কে বলেন, মেয়র আনিসুল হক আর আসবেন না। তার কাছাকাছি যাওয়ার যোগ্যতা কারও নাই। উনি যেভাবে মাঠে দৌড়াতেন যেভাবে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতেন সেই কাজের ধারের কাছেও নেই বর্তমান মেয়র। আসলে মেয়র আনিসুল হক সাহসী ছিলেন। আর উনি দৌড়াতেন পিছে পিছে আমলারা দৌড়াতেন। আর এখন মেয়র শুধু কর্মকর্তাদের কাছে পরামর্শের জন্য বসে থাকেন। তারা যেভাবে গাইড লাইন করেন সেভাবেই চলেন।


২০১১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বিভক্তের পর ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল প্রথমবারের মত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর দুই মেয়র ওই বছর ৬ মে শপথ গ্রহণ করেন। সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন অনুযায়ী, পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার ১৮০ দিন আগে যেকোনো সময় ভোট করতে হবে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই আগামী বছরের মে মাসকে ভোটের জন্য প্রাথমিক তারিখ হিসেব নির্ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে মে মাসে যেহেতু রমজান তাই আগের মাস অর্থাৎ এপ্রিলের শেষ নাগাদও হতে পারে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। তবে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের মে মাসকে নির্বাচনে সম্ভাব্য তারিখ রেখে খসড়া করা হয়েছে। কমিশন চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে তারিখ চূড়ান্ত করা হবে। ইতোমধ্যে এ নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছে কমিশন। সিদ্ধান্ত যাই হোক আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসেই চূড়ান্ত হয়ে যাবে কবে ভোট হবে তিন সিটিতে।

আইন অনুযায়ী নির্বাচনের পর মেয়রদের প্রথম কমিশন সভা থেকে মেয়রদের টাইম লাইন ধরা হয়। সেই হিসেব অনুযায়ী নির্বাচনের পর ঢাকা উত্তর সিটিতে প্রথম সভা হয় ২০১৫ সালের ১৪ মে, দক্ষিণ সিটিতে ১৭ মে ও চট্টগ্রাম সিটিতে প্রথম সভা হয় একই বছরের ০৬ আগস্ট। সেই হিসাবে ঢাকা উত্তরের ক্ষেত্রে এই মেয়াদ হবে ২০২০ সালের ১৩ মে পর্যন্ত, দক্ষিণে ওই বছরের ১৬ মে পর্যন্ত। চট্টগ্রাম সিটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২০ সালের জুলাইয়ে।


হিসেব মতে মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়াদ মাত্র ১২ মাস। এরইমধ্যে চার মাস অতিক্রম করেছেন। বাকী আছে আর ৮ মাস। বিগত চার মাসের কাজের গতি দেখে অনেকেই বলছেন বাকী ৮ মাসেও কোনো সিদ্ধান্ত পৌছাতে পারবেন না মেয়র। ফলে মেয়র আনিসুল হক এর রেখে যাওয়া উদ্যোগগুলোও আর আলোর মুখ দেখবে না।


 

এ সম্পর্কিত আরও খবর