বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য অন্তত ৭ হাজার ১২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ লাগবে, যা বাংলাদেশের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের মোট বাজেটের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। এ অর্থ মোট রাজস্বের ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ১৩ শতাংশেরও বেশি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) পরিচালিত গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে সিপিডি আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সঙ্কট: বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে এসব তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে সেমিনার সঞ্চালনা করেন সংস্থার বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এতে বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক, বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ ডেপুটি হাইকমিশনার ডেবিট এসলে, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার শাখাওয়াত হোসেন, বিশ্ব বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. সুকমল বড়ুয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রমুখ।
সভাপতির বক্তব্যে ড. রেহমান সোবহান তার বক্তব্যে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যায় দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এ সমস্যা বেশিদিন জিইয়ে রাখা যাবে না। এজন্য আন্তর্জাতিক মহলকে সঙ্গে নিয়ে ধীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘ভারত উপমহাদেশে জাতিগত সমস্যা দীর্ঘদিনের। সেনাবাহিনী এসব ইস্যু জিইয়ে রাখে, তারাই এর সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের হাতেই এর চূড়ান্ত সমাধান রয়েছে। তবে জাতিগত নিধন বন্ধে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে।’
বিশ্বব্যাপী ৬৫ মিলিয়ন মানুষ এখন উদ্বাস্তু জানিয়ে ড. দেবপ্রিয় বলেন, একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ চতুর্থ সর্বোচ্চ উদ্বাস্তু আশ্রয়দাতা। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বিরাট বোঝা।
এটা বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে এখনই এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
অধ্যাপক ড. সুকমল বড়ুয়া বলেন, এটি মানবতার সমস্যা। মুসলিম বা বুদ্ধ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘যখন কোনো জাতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা পরিচালিত হয়, তখন এটা আর দুই দেশের ইস্যু থাকে না, আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে যায়। তাই রোহিঙ্গাদের শরণার্থী বলতে হবে এবং অবশ্যই তাদের ফিরিয়ে নিতে হবে।’ এজন্য চীন, রাশিয়া ও ভারতে শক্তিশালী প্রতিনিধি দল পাঠানোর পরামর্শ দেন তিনি।
পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বক্তব্যে বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো দেশ একজন রোহিঙ্গাকেও নিতে চায়নি। তৃতীয় কোনো পক্ষও এগিয়ে আসেনি।
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে শিগগিরই মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে চলতি মাসেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশটি সফরে যাবেন বলেও জানান তিনি।
রোহিঙ্গা সংকটের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বাংলাদেশ বহুমাত্রিক সমস্যায় পড়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশের ওপর। এ তিন খাতে বাংলাদেশ নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনীতিতে প্রভাব পড়ায় জীবন যাপনের ব্যয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের সংকট তৈরি হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পর্যটন।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় সামাজিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন সমস্যা, স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নেতিবাচক ধারণা দেখা দিয়েছে।
পরিবেশের ওপর রোহিঙ্গা সংকটের প্রভাব তুলে ধরে তিনি বলেন, কক্সবাজারে মোট বনভূমির পরিমাণ ২০ লাখ ৯২ হাজার ১৬ একর। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে এরই মধ্যে ৩ হাজার ৫০০ একর বনভূমির ক্ষতি হয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী অধ্যুষিত এলাকায় বায়ু দূষণ, ভূমিধসের মতো ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে জীবন-জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
সিপিডির পক্ষ থেকে কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
প্রস্তাবগুলোর মধ্যে ‘বিমসটেক’ ও ‘বিসিআইএম’-এর মতো আঞ্চলিক জোটের মাধ্যমে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ, ‘আসিয়ান’-এর মতো অতিরিক্ত আঞ্চলিক জোটকে যুক্ত করে সমস্যা সমাধানে কাজ করা। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সম্পদের যোগানের ব্যবস্থা করা, জেনেভা বৈঠক পরবর্তী ফলো-আপ মিটিং করে অর্থ সংগ্রহে এখনই প্রস্তুতি নেওয়া এবং বিশ্বব্যাংকের মতো দাতা সংস্থার কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য শুধু অনুদান হিসেবে সহায়তা সংগ্রহ এবং রোহিঙ্গা ও দেশের দক্ষিণাঞ্চলের নিরাপত্ত ব্যবস্থা জোরদার করা।