বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণ: প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বাণী

, জাতীয়

News Creator | 2023-08-24 11:15:39

প্রথম বণিজ্যিক স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ এর সফল উৎক্ষেপণের মধ্যে দিয়ে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশের মহাকাশ যুগের সূচনা হল।     

বাংলাদেশ সময় শুক্রবার রাত ২টা ১৪ মিনিটে স্পেসএক্স এর ফ্যালকন-৯ রকেটের নতুন সংস্করণ ব্লক ফাইভ ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাড থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হয় মহাকাশের পথে। মোটামুটি আধা ঘণ্টার মাথায় বঙ্গবন্ধু-১ পৌঁছে যায় জিওস্টেশনারি ট্রান্সফার অরবিটে।

স্পেসএক্সের লাইভ ওয়েবকাস্টের মধ্যেই ধারণ করা এক ভিডিওবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হলাম। প্রবেশ করলাম নতুন যুগে।”

বাংলাদেশের এই স্বপ্নযাত্রা শুরু হল কেনেডি স্পেস সেন্টারের সেই ‘৩৯-এ’ লঞ্চ কমপ্লেক্স থেকে, যেখান থেকে ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাপোলো-১১’ মহাকাশযানটি মানুষকে পৌঁছে দিয়েছিল চাঁদে।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের গায়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার রঙের নকশার ওপর ইংরেজিতে লেখা রয়েছে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু ১। বাংলাদেশ সরকারের একটি মনোগ্রামও সেখানে রয়েছে।

উৎক্ষেপণের দেড় মিনিটের মাথায় ফ্যালকন-৯ ম্যাক্স কিউ অতিক্রম করে। নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছে রকেটের স্টেজ-১ খুলে যাওয়ার পর স্টেজ-২ কাজ শুরু করে।

পুনরায় ব্যবহারযোগ্য স্টেজ-১ এরপর সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং অবতরণ করে আটলান্টিকে ভাসমান ড্রোন শিপে।

কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক সে সময় বলেন, “সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট সফলভাবেই কক্ষপথের দিকে যাত্রা করেছে।”

উৎক্ষেপণের মোটামুটি সাড়ে ৩৩ মিনিটের মাথায় বঙ্গবন্ধু-১ পৌঁছে যায় জিওস্টেশনারি ট্রান্সফার অরবিটে। রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মহাশূন্যে গা ভাসায় বাংলাদেশের প্রথম কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট।

কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বিটিআরসি চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ বলেন, “উৎক্ষেপণ সফল হয়েছে। জিওস্টেশনারি ট্রান্সফার অরবিটে স্থাপিত হয়েছে আমাদের স্যাটেলাইট।”

রকেট থেকে উন্মুক্ত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার তিনটি গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে বঙ্গবন্ধু-১ এর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কথা। সব মিলিয়ে ৩৬ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে মহাকাশের ১১৯.১ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে নিজস্ব অরবিটাল স্লটে স্থাপিত হবে এই কৃত্রিম উপগ্রহ।

 তবে অরবিটাল স্লটে স্যাটেলাইটকে বসিয়ে কাজ শুরু করতে সময় লাগবে প্রায় দুই মাস। তখন গাজীপুরের জয়দেবপুর আর রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ার গ্রাউন্ড স্টেশন থেকেই এর নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতার ওপর ভিত্তি করে কক্ষপথকে চিহ্নিত করা হয় তিনভাবে। এগুলো হল লো আর্থ অরবিট (এলইও), জিওস্টেশনারি আর্থ অরবিট (জিইও) এবং মিডিয়াম আর্থ অরবিট (এমইও)। সব কাজ শেষে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ হবে ‘জিওস্টেশনারি আর্থ অরবিটের’ একটি কৃত্রিম উপগ্রহ।  

জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট হল এমন একটি কৃত্রিম উপগ্রহ যেটি নিরক্ষ রেখা বরাবর ওই কক্ষপথে থেকে পৃথিবীকে ২৪ ঘণ্টায় একবার প্রদক্ষিণ করবে। এই প্রদক্ষিণ হবে পৃথিবীর আবর্তনের দিকে, অর্থাৎ পশ্চিম থেকে পূর্বে। ফলে গ্রাউন্ড স্টেশনের সাপেক্ষে উপগ্রহটি থাকবে প্রায় স্থির। এ কারণেই ‘জিওস্টেশনারি’ শব্দটি এসেছে।

স্পেসএক্সের ইউটিউব চ্যানেলে এই উৎক্ষেপণের ‘লাইভ  স্ট্রিমিং’ দেখানো হয়। আর  রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল বিটিভি ওই উৎক্ষেপণ সরাসরি সম্প্রচার করে। টেলিভিশন আর কম্পিউটারে চোখ রেখে ইতিহাসের সাক্ষী হয় রাত জাগা মানুষ।

সফল উৎক্ষেপণ শেষে রকেট ফ্যালকন ৯ ব্লক ৫ আটলান্টিকের বুকে ভেসে থাকা ড্রোন জাহাজে সফলভাবে অবতরণ করেছে।

এই উৎক্ষেপণের দায়িত্বে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএক্স জানিয়েছে, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটটি কক্ষপথে তুলে দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের ‘অফ কোর্স আই স্টিল লাভ ইউ’ নামে ড্রোন শিপে সফলভাবে অবতরণ করেছে রকেটটি।

লঞ্চ প্যাড থেকে উৎক্ষেপণের আট মিনিট ৪৫ সেকেন্ড পর দুই স্টেজের এই রকেটটির স্টেজ-১ পৃথিবীতে ফিরে আসে। তার আগে আড়াই মিনিটের মাথায় স্টেজ-১ ‍ও স্টেজ-২ আলাদা হয়।

স্টেজ-২ এরপর ৩৩ মিনিটের মধ্যে কক্ষপথে স্থাপন করে বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহটিকে; স্টেজ-১ ফিরে আসে পৃথিবীতে।

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের এই দিনকে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের একটি দিন অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আজ আমরাও স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য হলাম। প্রবেশ করলাম এক নতুন যুগে।

“এখন মহাকাশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন হবে।”

বাংলাদেশের জাতির জনকের নামাঙ্কিত এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার, টেলিযোগাযোগ ও ডেটা কমিউনিকেশন সেবা পাওয়া যাবে।

 এই স্যাটেলাইটের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তাজিকস্তান, কাজাকস্তান ও উজবেকিস্তানের অংশ বিশেষে সেবা প্রদান করা সম্ভব বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিতেন। 

মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠানোর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণের পথে একধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।

মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, এটি গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা।

“আজকের দিনটি জাতির জন্য অত্যন্ত আনন্দের, গর্বের। এখন থেকে বাংলাদেশ হবে স্যাটেলাইট ক্লাবের গর্বিত সদস্য। মহাকাশে এই উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হল।”

রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন জানান, স্যাটেলাই উৎক্ষেপণের সময় রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবন থেকে টেলিভিশনের সরাসরি সম্প্রচার দেখেন।

রাষ্ট্রপতি এই ক্ষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান।

রাষ্ট্রপতি বলেন, “একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য বর্তমান সরকার নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত ও সহজলভ্য করার ক্ষেত্রে ক্যাবলের পাশাপাশি স্যাটেলাইট সেবা সংযোজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ছিল অপরিহার্য।

“বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের ফলে দেশের ব্রডকাস্টিং ও টেলিযোগাযোগ সেক্টরে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস। ব্রডকাস্টিং ও টেলিকমিউনিকেশনে পরনির্ভরশীলতা পরিহার করে আমরা এই সেক্টরে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হবো।”

রাষ্ট্রপতি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, বিটিআরসি, স্যাটেলাইট প্রকল্প এবং বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ এই স্যাটেলাইট নির্মাণ, উৎক্ষেপণের সঙ্গে জড়িত সকলকে ধন্যবাদ জানান।

এ সম্পর্কিত আরও খবর