ডেঙ্গু আতঙ্কঃ দিশেহারা দুই মেয়র, সক্রিয় প্রশাসন

ঢাকা, জাতীয়

রেজা-উদ্-দৌলাহ্ প্রধান, স্টাফ করেপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা | 2023-08-30 06:45:24

ডেঙ্গু জ্বর আতঙ্কে ভুগছে ঢাকা শহরের মানুষ। প্রাণঘাতী এ জ্বর ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ায় রাজধানীর হাসপাতাগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীতে ছেয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছেন।

এদিকে ঢাকার দুই মেয়রের সামনে আচমকা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে ডেঙ্গুর ভাইরাস বাহক ছোট এডিস মশা। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে দিশেহারা নগরের দুই মেয়র। তিন সপ্তাহেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে তারা এখন নগরবাসীর চক্ষুশূল। দুই মেয়রকে ব্যঙ্গ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রল করা হচ্ছে। এমনকি রাজপথের কর্মসূচিও পালন করছেন অনেকে।

তবে মেয়ররা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দিশেহারা হয়ে পড়লেও বসে নেই প্রশাসন। ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং দফতরগুলোকে নিয়ে সমন্বয় সভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিধন অভিযান জোরদার করার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে বিশেষ মেডিকেল টিম গঠনের নির্দেশনা দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য সেল/কর্ণার চালু/ শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি করা শুরু হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে ডেঙ্গু শনাক্তকরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, ডেঙ্গু মরাত্বক আকার ধারণ করলেও এখনি মহামারী হিসেবে ঘোষণার পরিকল্পনা প্রশাসনের নেই বরং ডেঙ্গু মোকাবিলা করে পরিস্থিতি কত দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সে ব্যাপারে তৎপর রয়েছে প্রশাসন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার (২৬ জুলাই) সকাল ৮ থেকে শনিবার সকাল ৮ পর্যন্ত সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৬৮৩ জন। এই সংখ্যা গত এক মাসের (২৬ জুন-২৭ জুলাই) মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। এর আগে সবচেয়ে বেশি ৬৬৩ জন রোগী ভর্তি হয়েছে গত ২৪ জুলাই।

অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বছরের শুরুর দিন থেকে শনিবার (২৭ জুলাই) পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১০ হাজার ৫২৮ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে সাত হাজার ৮৪৯ জন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন।

গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেই ভর্তি হয়েছে ৬৪৩ জন ডেঙ্গু রোগী। সবচেয়ে বেশি ২৩৩ জন ভর্তি হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এছাড়া রাজধানীর বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে আরও ১১৪ জন ডেঙ্গু রোগী গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ২০ জনের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে এলেও সরকারি খাতায় মৃতের সংখ্যা আগের মতো আট জনই রয়েছে।

এদিকে ডেঙ্গু মারাত্মক আকার ধারণের পেছনে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়রের উদাসীনতাকে দায়ি করছেন নগরবাসী। এমনকি আদালতের আদেশ ও নির্দেশনা পালনেও ছিল তাদের গাফিলতি।

জানা গেছে, গত মার্চেই ডেঙ্গুর ভয়াবহতা সম্পর্কে সর্তক করেছিলেন হাইকোর্ট। দুই সিটির নির্বাহী প্রধানদের হাইকোর্টে ডেকেও আনা হয়েছিল, কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও পরামর্শ আমলে নেয়নি দুই সিটি কর্তৃপক্ষ। এরপর ১৪ জুলাই এডিস মশা নির্মূল ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। আদালতের আদেশ সত্ত্বেও এডিস মশা নির্মূলে কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়ায় গত ২২ জুলাই দুই সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদ্বয়কে তলব করেন হাইকোর্ট।

এদিকে মাসের শুরুতে মানুষ যখন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হতে থাকে তখন থেকে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে মেয়র সাঈদ খোকন মিডিয়ায় নানা বক্তব্য দিয়ে নগরবাসীর হাস্যরসের পাত্রে পরিণত হন। ডেঙ্গু নিরাময়ে পেঁপে পাতার রস খাওয়া থেকে শুরু করে, ডেঙ্গু আক্রান্তদের সংখ্যা নিয়ে ছেলেধরা গুজবকে তুলনা, সবকিছুই তার বিপক্ষে যায়। বক্তব্যে নগরবাসীর কেউ হাসাহাসি করেন, কেউ ক্ষিপ্ত হন। অন্যদিকে উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম নাগরিক সচেতনতা আর আইন প্রয়োগের ওপর জোর দিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালান।

দক্ষিণ সিটির লালবাগ থানার অধিবাসী বাপ্পাদিত্য বসু বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম-কে বলেন, 'দক্ষিণ সিটির মেয়র সাঈদ খোকন বসবাস করেন উত্তরের বনানীতে। যে মেয়র তার নিজের এলাকাতেই থাকেন না তিনি মানুষের কষ্ট বুঝবেন কি করে? আমার এলাকায় আমি মশা নিধনের ফগার স্প্রে মেশিন দেখিনি গত ছয় মাসে। ডেঙ্গু এখন মারাত্মক আকার ধারণ করছে। অথচ মেয়র বলে কিনা গুজব।'

দুই মেয়রের কার্যক্রমে যারপরনাই বিরক্ত ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার পরও দুই মেয়রের বালখিল্য কথাবার্তায় বিব্রত দলীয় হাই কমান্ড। কেননা দুই মেয়রের ব্যর্থতার দায়ভার আওয়ামী লীগের কাঁধে এসে পড়েছে। দলের নেতা-কর্মীরাই মেয়রদ্বয়ের সমালোচনায় সরব। এমন পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যেই দুই মেয়রকে সরকারের কঠোর মনোভাবের কথা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বেশি কথা না বলে এডিস মশা মোকাবিলার কাজে মনোনিবেশ করতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণসম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, 'আমাদের সবার কথাবার্তায় সংযত হওয়া উচিত। আমরা অনেক সময় দায়িত্বহীন কথা বলে থাকি। সকলের দায়িত্বশীল কথাবলা উচিত।'

এ সম্পর্কিত আরও খবর